ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন কি মুছে যাবে?

প্রাচীনকালের ‘চাটিগ্রাম’ থেকে বর্তমানের চট্টগ্রাম। মাঝে হাজার বছরের ইতিহাস। বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক এলাকায় এবং নদী-পাহাড়-জঙ্গল পরিবেষ্টিত স্থানে মিশ্র সংস্কৃতির এই জনপদের অবস্থান। এই নগরের কর্ণফুলী নদীর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ে গড়ে ওঠা বন্দরের ইতিহাসই প্রায় বার শ বছরের। শত শত বছর ধরে এটি আন্তর্জাতিক সংযোগস্থলও। পাশাপাশি সারা পৃথিবীর প্রাচীন বন্দরগুলোরও একটি। এই বন্দর ঘিরেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চঞ্চল নগর চট্টগ্রাম ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের দশম দ্রুত বর্ধনশীল মহানগর এটি।
এই অঞ্চলের দীর্ঘকালীন ঐতিহাসিক ভূমিকার সপক্ষে পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বাংলা সরকারের গণপূর্ত বিভাগ প্রথম চট্টগ্রামের স্থাবর পুরাকীর্তির তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু এরপর পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আমলে সরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের স্থাবর বা অস্থাবর পুরাকীর্তির কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান জরিপ পরিচালিত হয়েছে—জানা যায় না। স্থানীয় সরকার বা প্রশাসনেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দায়িত্ব হিসেবে পুরাকীর্তি রক্ষায় কোনো কর্মসূচি বা দপ্তরের সক্রিয়তা নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা-উপাচার্যের নীতিনির্ধারণী বক্তৃতায় যে কয়টি বিশেষ বিভাগ নব্যপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলার প্রতিশ্রুতি ছিল, প্রত্নতত্ত্ব তার একটি।
চট্টগ্রামের স্থাবর-অস্থাবর পুরাকীর্তি নিয়ে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতেরা অনেক গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। সাধারণ মানুষের অজানাই থেকে গেছে এই ইতিহাস। স্থাবর পুরাকীর্তিগুলো প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করেনি এবং সংরক্ষিত হয়নি। অস্থাবর পুরাকীর্তিগুলো দেশে এবং পাচার হয়ে দেশের বাইরে জাদুঘরে ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে ঠাঁই পেয়েছে। চট্টগ্রামের অস্থাবর পুরাকীর্তির প্রথম সন্ধান দেন জন শোর, ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে। স্থানীয় এক গুহায় পাওয়া রুপার ফলকে ‘মগ’ ভাষায় উৎকীর্ণ লিপির ইংরেজি অনুবাদ এশিয়াটিক রিসার্চেজ পত্রিকার দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে অশ্মীভূত কাঠে তৈরি কয়েকখানা অস্ত্র আবিষ্কৃত হলে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা প্রাগৈতিহাসিক কালে গিয়ে পৌঁছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঝিয়রি গ্রামে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত ভাস্কর্য-ভান্ডার নিয়ে ভারতের গবেষকেরা দুটি বই প্রকাশ করেছেন। এই ভান্ডারের উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি সংরক্ষিত হয়েছে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে। অথচ ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জোবরা গ্রামে আবিষ্কৃত হরিকেলের মুদ্রাভান্ডার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে জমা পড়েছে বাংলাদেশ কোয়ার্টারলি সূত্রে জানা গেলেও এখন হদিস পাওয়া মুশকিল।
চট্টগ্রাম টাঁকশালে তৈরি মধ্যপূর্ব ও মধ্যযুগের মুদ্রাগুলো অস্থাবর পুরাকীর্তির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। সাধারণ সমীক্ষায় এখানে মুদ্রা জারির (টাঁকশাল থেকে মুদ্রাবাজারে ছাড়া) অন্তত ছয়টি সময়কাল চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এই সময়কালের ছয়টি যুগের প্রতিনিধিত্বকারী মুদ্রা রয়েছে। এগুলো হলো: হরিকেল মুদ্রা, আকর মুদ্রা, সুলতানি মুদ্রা, বাণিজ্য মুদ্রা (‘ট্রেড কয়েন’ নামে খ্যাত), আরাকানি মুদ্রা ও মোগল মুদ্রা। সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের একটি দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে এই মুদ্রাগুলো। কোনো কোনো পর্যায়ের মুদ্রায় সমকালীন রাজনৈতিক সংস্কৃতির মেলবন্ধনের নমুনাও আছে। দেশ-বিদেশের নানা সংগ্রহে রক্ষিত চট্টগ্রাম টাঁকশালের মুদ্রার ধারাবাহিক বিবরণমূলক পঞ্জি এক প্রকাশনায় গবেষকদের কাছে সহজলভ্য করা সম্ভব হয়নি শুধু উদ্যোগের অভাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খোলা হলে চট্টগ্রামের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অগ্রসর হওয়ার এবং এ বিষয়ে লোকবল সৃষ্টির পরিসর তৈরি হতো। সমৃদ্ধ হতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর।
২.
চট্টগ্রামের দানিলেখ (ফুলদানি আকারের ধাতব পাত্রে খোদিত লিপি) ও তাম্রশাসনগুলো (তামার পাত্রে খোদিত লিপি) মধ্য–পূর্ব যুগের অন্যতম অস্থাবর প্রত্ননিদর্শন। প্রাচীন বর্ণমালার নমুনা খোদাই করা দেখতে পাওয়া যায় ধাতব পাত্রে বা পাতে। হরিকেলের ইতিহাসের কিছু তথ্য আছে এসব উপাদানে। ১২৪৩ খ্রিষ্টাব্দে উৎকীর্ণ দামোদর দেবের নাসিরাবাদ তাম্রশাসনটি চট্টগ্রামে আবিষ্কৃত হওয়ার পর কালেক্টর এ এল ক্লে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষণের জন্য পাঠান। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এর পাঠোদ্ধার করে প্রকাশের ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে শাসনটি সোসাইটির আর্কাইভ থেকে হারিয়ে যায়। চট্টগ্রামের স্থাবর পুরাকীর্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মোগল ঐতিহাসিক শাহাবুদ্দিন তালিশের বিবরণে। বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি প্রাচীন দুর্গ এবং দুর্গের আঙিনায় পীর বদরের আস্তানার কথা উল্লেখ করেন। তালিশের সূত্রে আরও জানা যায় যে অতীতকালে সোনারগাঁয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। মোগল বিজয়ের পর সুবাহদার শায়েস্তা খানের নির্দেশে ফেনী থেকে চট্টগ্রামের পথে ৯০টি পুল নির্মাণের তথ্যও সরবরাহ করেন তালিশ। মধ্যযুগের পুঁথিসাহিত্যে শহর চট্টগ্রামের বর্ণনায় স্থাবর পুরাকীর্তির উল্লেখ লক্ষ করা যায়। আনুমানিক ১৬০০-০৭ খ্রিষ্টাব্দে বাহরাম খান রচিত লায়লি-মজনু কাব্যে চট্টগ্রাম নগরে অনেক সাধু-সজ্জনের নিবাস এবং দুর্গের সীমানায় বদর আলমের (শাহ বদর আউলিয়া) সমাধিসৌধের কথা লেখা আছে। স্থাবর পুরাকীর্তিগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ উদ্যোগের অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন পুরাকীর্তির অনুসন্ধান ও জানা পুরাকীর্তিগুলোর নকশাচিত্রসহ প্রামাণ্য বিবরণ তৈরির কাজে উপেক্ষা। মহানগর এলাকাতেই কয়েকটি স্থাপত্যকীর্তি সম্প্রতি অপসারিত হয়েছে অন্যায্যভাবে।
মুসলিম স্থাপত্যের অলংকরণে লিপিকলা ও মোটিফের ব্যবহার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে গরীয়ান। লিপিকলায় দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টি পাথরে খোদাই করা শিলালিপি। চট্টগ্রামে সুলতানি, আরাকানি ও মোগল যুগের অসংরক্ষিত স্থাপত্যে বেশ কিছু শিলালিপি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণভাবে দুই ধরনের লেখের সন্ধান পাওয়া যায়: ১. ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি এবং ২. ইতিহাসের তথ্য–উপাদানসমৃদ্ধ শিলালেখ। হাটহাজারীর একটি হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সম্প্রতি পাওয়া একটি শিলালেখও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে সংগৃহীত হয়েছে জানা যায়। আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে চট্টগ্রামের মুসলিম শিলালিপি নিয়ে প্রথম গবেষণার কৃতিত্ব প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ রাখাল দাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। হাটহাজারি থানার জোবরা গ্রামে আলাওল দিঘির পাড়ের মসজিদে উৎকীর্ণ স্বাধীন বাংলার সুলতান রুকুনুদ্দিন বারবক শাহের শিলালিপিটি অধ্যয়ন করে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্নাল অব দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িশষ্যা রিসার্চ সোসাইটিতে প্রকাশ করেন। অযত্নে অবহেলায় কিছু শিলালিপি বিলুপ্ত হয়েছে বলেও মনে হয়, যেমন মোগল আমলের মালখার মসজিদের শিলালিপি। ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত করে তরুণ প্রজন্মকে দেশচেতনায় উজ্জীবিত করা যেতে পারে। এ কাজে অগ্রসর হওয়ার উপায় ঐতিহ্যের উপাদান অনুসন্ধান, ডকুমেন্টেশন, সংরক্ষণ ও উপস্থাপন। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরস্পরের সহায়তায় চট্টগ্রামের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব।
লেখক: ইতিহাসবিদ ও সদস্যসচিব, চিটাগং সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ