ইলিশের নৌকায় এক দিন

জাল তুলতেই দেখা গেল ইলিশ, ফুটে উঠল জেলেদের মুখে হাসি। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
জাল তুলতেই দেখা গেল ইলিশ, ফুটে উঠল জেলেদের মুখে হাসি। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
খুলনা ও আশপাশের নদীগুলোতে এবার বেশ ভালোই ইলিশ পাওয়া গেছে। ইলিশ ধরা দেখাও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ১৭ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের পশুর নদে ইঞ্জিনচালিত এক জেলে নৌকায় বসে দেখা হলো ইলিশ ধরার পুরো প্রক্রিয়া। সেদিন সেই নৌকায় ধরাও পড়ে কয়েকটি ইলিশ। পশুর নদে ইলিশ শিকারের সেই অভিজ্ঞতা থাকছে এবারের ছুটির দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে

বেশ কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, এ বছর খুলনা ও আশপাশের বিভিন্ন নদ-নদীতে বেশ ভালোই ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এমন খবরে জেলেদের নৌকায় বসে ইলিশ ধরা দেখার ইচ্ছাটা প্রবল হতে থাকে। ইচ্ছা বাস্তবেও রূপ নিল, যখন একদল শৌখিন ইলিশ শিকারির আমন্ত্রণ এল আমাদের কাছে। ঠিক হলো, ১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে আমরা জেলেদের সঙ্গে সুন্দরবনের পশুর নদে ইলিশ ধরা দেখব।

জাল সারিয়ে নিচ্ছেন একজন জেলে
জাল সারিয়ে নিচ্ছেন একজন জেলে

প্রস্তুতি পর্ব

আগের দিন বিকেলে খুলনা থেকে রওনা হলাম। গন্তব্য বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের কলাতলা গ্রাম। খেয়া পার হয়ে যখন মোংলা বাজারে পৌঁছালাম, তখন সুয্যিমামা পাটে যেতে বসেছে। আমাদের গন্তব্য তখন আরও সাত কিলোমিটার। এবড়োখেবড়ো পিচঢালা রাস্তা ধরে চিলাবাজারে যেতে যেতে অন্ধকার বেশ গাঢ় হলো। চিলাবাজার থেকে এবার ইট বিছানো পথ। পথ শেষ হয়েছে একবার পশুর নদের তীরে। রাত আটটার দিকে গন্তব্যে পৌঁছালাম।

রাতের খাবারে টাটকা ইলিশের নানা পদ। ঘুমানোর ব্যবস্থা নদের পারে এক টংঘরে। নদের ওপারে সুন্দরবন। পশুর নদে চলা কার্গো ট্রলার, জাহাজের শব্দ আর তীব্র আলো নীরবতা ভেঙে দিচ্ছিল বারবার।

ভাটার টান পড়েছে, এবার নদীতে নৌকা ভাসানোর পালা
ভাটার টান পড়েছে, এবার নদীতে নৌকা ভাসানোর পালা

শুয়ে শুয়ে শৌখিন ইলিশ শিকারি উত্তম রপ্তানের সঙ্গে চলছিল গল্প। তিনি বাগেরহাট পিসি কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। জানালেন, রাত তিনটার দিকে তাঁরা একবার নদে যাবেন মাছ ধরতে। কিন্তু গভীর রাত হওয়ায় ওই সময় আমাদের সঙ্গে নিতে চাইলেন না। ঠিক হলো, ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে যখন নদে ভাটা লাগতে শুরু করবে, তখন বের হব।

ভোররাতে বের হওয়া মাছ ধরার ট্রলারগুলো সকাল ৯টার দিকে ঘাটে ভিড়ল। পশুরে তখন জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করেছে। একেক জেলে ট্রলার ইলিশ পেয়েছে দুই থেকে ছয়টি পর্যন্ত। দিন চারেক আগে নাকি একেকটি জেলে নৌকায় প্রতিবার ১০-১৫টি করে ইলিশ পড়েছিল। অন্যান্য মাছই বেশি ট্রলারগুলোতে।

জেলেদের ট্রলারগুলো ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল আরও একটি নৌকা। নৌকায় থাকা একজন ওই ইলিশ মাছ কিনছেন। জানা গেল, তাঁর কাছ থেকেই মাছ ধরার জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে জেলেরা টাকা দাদন নিয়েছেন। এ জন্য যাঁরা টাকা ধার নিয়েছেন, তাঁরা অন্য কারও কাছে ইলিশ বিক্রি করতে পারেন না। অনেক কম দামে ঘাটে বসেই জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ নিয়ে যান দাদনদারেরা। ইলিশ বিক্রির সময় আরও একটি ব্যাপার চোখে পড়ল, দাদনদারের নৌকায় পাল্লা ও বাটখারা থাকে আর মাছ মেপে দেন জেলেরা। ছোট-বড় সব ইলিশ গড়ে একই দামে বিক্রি হয়। সেদিন সর্বোচ্চ এক কেজি ও সর্বনিম্ন আধা কেজি ওজনের ইলিশের গড় দাম ধরা হয়েছিল ৫০০ টাকা।

ইলিশ বিক্রির পর বাড়িতে গিয়ে খাওয়া এবং একটু বিশ্রাম নিয়ে জেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জাল মেরামতে। আমাদের অপেক্ষা ভাটা লাগার। বেলা দেড়টার দিকে আমরা প্রস্তুত হলাম নদে নামার। নদের পাড় থেকে নদী পর্যন্ত তখন প্রায় ২০০ মিটার চর জেগেছে। কয়েকজন মিলে কাদা ভেঙে ট্রলার ঠেলে নদে নামানো হলো।

নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে
নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে

ইলিশের জন্য যাত্রা শুরু

কাদা মাড়িয়ে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে উঠলাম। যখন ঘাট ছাড়ল, তখন ট্রলারে আমরা মোট আটজন। জেলে সুভাষ, ভূপেষ, তারাপদ, উত্তম, উৎপল; সঙ্গে আলোকচিত্রী সাদ্দাম হোসেনসহ প্রথম আলোর আমরা তিনজন। ট্রলারে নেওয়া হলো খাওয়ার পানি ও কিছু শুকনো খাবার। তবে স্থানীয় লোকজন বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে সারা বছর পান করে। যাই হোক, আমরা চললাম মাছ শিকারে।

জাল সমাচার

ইলিশ ধরার জাল বিশেষভাবে তৈরি। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় গলশা জাল। এই জালের প্রস্থ ১০ থেকে ১২ ফুট। দৈর্ঘ্য যে যাঁর মতো করে নেন। আমাদের ট্রলারের জালটি লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট। জালের শুরুর প্রান্তে ওপরের অংশে ৩০ লিটার ধারণক্ষমতার একটি খালি প্লাস্টিকের ড্রাম এবং নিচের প্রান্তে বাঁধা থাকে কয়েকটি আস্ত ইট। ১৫ ফুট পর পর জালটিকে ভাসিয়ে রাখার জন্য কালো রং করা ফাঁপা বাঁশের অংশ অথবা একই আকারের ফাঁপা প্লাস্টিকের সোলা। এগুলোর ঠিক নিচের অংশে রয়েছে গোলাকার পোড়ামাটির টালি। একেকটির ওজন কেজিখানেক। টালির ভার জালকে নিচের দিকে নিয়ে যায় আর বাঁশ বা সোলা জাল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে। ওপর ও নিচের অংশে টান টান থাকায় জাল নদীর পানির মধ্যে আড়াআড়িভাবে থাকে। ট্রলারের একটি অংশে টালিগুলো এক জায়গায় পর পর সাজানো থাকে। অন্য জায়গায় সাজানো থাকে সোলাগুলো। যতগুলো টালি, ঠিক ততগুলো সোলা।

জাল টেনে তুলছেন জেলে
জাল টেনে তুলছেন জেলে

জাল ফেলার পর্ব

কলতলা থেকে ট্রলার আড়াআড়ি চালিয়ে আমরা সুন্দরবনের পাড়ে পৌঁছে গেলাম। ট্রলারের মাঝি তারাপদ রপ্তান জানালেন, ভাটার স্রোত প্রবল, তাই এখন জাল ফেলা সম্ভব না। আমাদের ট্রলার হেলে পড়া এক বড় পশুর গাছের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য চাপানো হলো। মিনিট বিশেক পর ভাটার তীব্র স্রোত কিছুটা কমলে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বলে জানালেন মাঝি। এরই মধ্যে আরও বেশ কয়েকটি ট্রলারকে নদীর মাঝ বরাবর এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সুবিধাজনক জায়গায় যাতে অন্যরা আগে জাল ফেলতে না পারে, সে জন্য আমাদের মাঝি আর অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না। দ্রুত ট্রলার চালু করে উত্তর দিকে আর খানিকটা এগিয়ে শুরু হলো জাল ফেলা।

ট্রলার চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাল পড়তে থাকল নদের জলে। একটি টালি এরপর একটি সোলা—এভাবে ছন্দময় গতিতে জাল ফেলা শেষে জালের শেষ প্রান্ত দড়ি দিয়ে ট্রলারের সঙ্গে বাঁধা থাকল। এবার বন্ধ করা হলো ট্রলারের ইঞ্জিন। এরপর ভাটার স্রোতের মর্জিমতো মৃদুমন্দ গতিতে এগোতে থাকল জাল ও ট্রলার। আশপাশে তখন অনেক নৌকা থেকে জাল ফেলা হয়েছে।

সুন্দরবনের পশুর নদে সূর্য ডুবছে, ফিরতি পথে জেলে নৌকা
সুন্দরবনের পশুর নদে সূর্য ডুবছে, ফিরতি পথে জেলে নৌকা

জাল তোলার পালা

জাল ফেলার প্রায় ৪০ মিনিট পর জয়মনি এলাকার সাইলোর কাছাকাছি পৌঁছালাম আমরা। এবার জাল তোলার পালা।

জালের ওপরের অংশের দড়ি ধরে জাল টানা শুরু করলেন দুজন। একজন ওপরের অংশের সোলা একের পর এক সাজিয়ে রাখতে লাগলেন, আরেকজন সাজিয়ে রাখতে লাগলেন নিচের অংশের টালি। সব কাজ এমন নিখুঁত ও অভিজ্ঞ হাতে তাঁরা করতে লাগলেন, যেন জাল জড়িয়ে না যায়। পরেরবার ফেলার সময় কাজটা যেন সহজ হয়। ট্রলারে থাকা আমার উৎসুক চোখগুলো জালের মাঝে খুঁজতে থাকে ইলিশ। বেশ কিছুক্ষণ জাল তোলার পরও ইলিশের দেখা নেই। আমরা কিছুটা হতাশ, তবে জেলেদের মুখে হতাশা নেই। তাঁদের বিশ্বাস, ইলিশ পড়বেই।

কিছু সময় নীরব উৎকণ্ঠার মধ্যেই হঠাৎ উঠে এল সোনালি আভার ঝকঝকে এক ইলিশ। কেজিখানেক ওজনের ইলিশটি মিনিট দুই লাফাতেই নিথর হয়ে গেল। অন্যদিকে চলতে থাকল জাল টানা। আগ্রহ বেড়ে গেল আরও বেশি। এরপর আবার কিছুক্ষণ ইলিশের দেখা নেই। তবে হতাশ হতে হয়নি। জালের শেষ প্রান্ত নৌকায় উঠতে উঠতে জমা হলো ছয়টি ইলিশ। এগুলোর আকার প্রথমটির চেয়ে ছোট।

এবার জাল তোলার পালা। ছবি: প্রথম আলো
এবার জাল তোলার পালা। ছবি: প্রথম আলো

আবার ইলিশ শিকার

প্রস্তুতি শুরু হলো দ্বিতীয় দফার। আগেরবার যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে আবার জাল ফেলা শুরু। ফেলতে ফেলতে এবার জাল শেষ হলো সুন্দরবনের আন্ধারিয়া খালের মুখে। খালের মুখে কাইন ও ভেটকি মাছ ধরছেন অন্য জেলেরা। এখানে দেখা মিলল চিত্রা হরিণের। খালপাড়ে পানি পান করতে এসেছে ও। আধা ঘণ্টা পর আবার জোয়ার। শ্যালা ও পশুরের মোহনা থেকে আসতে শুরু করল কার্গো ট্রলার। আমাদের মাঝি এবার ট্রলারের হাল অন্য একজনের হাতে দিয়ে সঙ্গে থাকা লাল গামছা লাঠির মাথায় বেঁধে কার্গোচালকদের জালের সীমানায় না আসার সংকেত দিতে থাকলেন। অন্য নৌকার জেলেরাও একই পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। দ্বিতীয় দফায় মিলল তিনটি ইলিশ। এ রকম ইলিশ ধরা চলবে আজ ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কাল ১ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে ইলিশ ধরা।

ধরা পড়া ইলিশ মাপা হচ্ছে
ধরা পড়া ইলিশ মাপা হচ্ছে

ইলিশের সঙ্গে ফেরা

ততক্ষণে সুন্দরবনের মাথার ওপর সূর্য ডুবতে বসেছে। জোয়ারের পানিতে টইটম্বুর পশুর। এবার ফেরার পালা। পাশ দিয়ে ফিরছে অন্য জেলে ট্রলারগুলোও। গোধূলির লাল-সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে পশুরের বুকজুড়ে। আমাদের ট্রলারে রুপালি-সোনালি আভা ছড়াচ্ছে কয়েকটি ইলিশ।