ইশরাত, তোমাকে খোলা চিঠি
>

১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ইশরাত আখন্দের খুব কাছের মানুষ ছিলেন সাফিনা রহমান। নানা কাজে শুধু সহযোদ্ধাই ছিলেন না তাঁরা, দুজন দুজনের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বন্ধু ও বোনসম। ইশরাত আখন্দকে এই খোলা চিঠি লিখেছেন তিনি।
ইশরাত,
তুমি তো আর এলে না। তোমার না পরের দিন আসার কথা ছিল? হঠাৎ করেই না বলে কোথায় চলে গেলে? তোমার মায়ামাখা হাসিটা এখনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে চোখের সামনে। কী অপূর্ব, শীতল, সুন্দর তাকানো ছিল তোমার। ওই চোখ দুটিতে নিত্য স্বপ্ন খেলা করত। একটা আলোর ভোর—তুমি, আমি, আমরা একসঙ্গে চেয়েছিলাম। একসঙ্গে, একপথে বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক দূর যেতে চেয়েছিলে তুমি। অথচ, এই আমাদের মাঝপথে রেখে তুমিই চলে গেছ।
তোমার জন্য রেখে দেওয়া শাড়িটা প্রতিদিন দেখি। বারবার দেখি। এখন কেউ আর এ শাড়ি নিতে আসবে না। শাড়িটায় হাত বোলাতে বোলাতে ভাবি, এ শাড়ি পরেই তো তুমি আঁধারে আলো জ্বালানোর কোনো মিছিলে যোগ দিতে পারতে। তোমার গায়ে এ শাড়ি জড়িয়েই তুমি নতুন কোনো স্বপ্নের আড্ডা জমিয়ে তুলতে পারতে। কিন্তু তা করলে না, করতে পারলে না।
কই, কখনো তো তোমাকে কারও কোনো ক্ষতি করতে দেখিনি। তাহলে তোমাকে কেন এমন নির্মম, নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হলো? তোমার সঙ্গে একইপথে চলে যেতে হলো ফুটফুটে সুন্দর ফারাজ আর অবিন্তাকে। কজন বিদেশি নাগরিকও সেদিন ছিলেন তোমাদের সঙ্গে। ইশ্, তোমাদের বুঝি অনেক কষ্ট হয়েছে? ইশরাত, আমি ভাবতে পারছি না। অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে, পুরো দেশকে কুঁকড়ে দিয়েছে।
তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল, ইশরাত। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনাও ছিল বিস্তর। মাঝেমধ্যে হুট করেই চলে আসতে। চোখমুখ টানটান করে বলতে—এটা করতে চাও, ওটা করতে চাও। আমি অকপটেই সায় দিতাম। সেসবের অনেক কিছুই তো করা হলো না। তুমি আর আমি একসঙ্গেই রোটারি ক্লাব ও জেসিআই (জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল) করতাম। তোমার দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করেছে ভীষণ। অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ ছিলে তুমি, ইশরাত।
মনে পড়ে একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ করে কলবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি, তুমি। ভিজে একাকার। ইশরাত তুমি নিজেই গাড়ি চালাতে। সেদিন গাড়িটি নষ্ট ছিল। রিকশা করে বৃষ্টিতে ভিজে তুমি এসেছিলে। বলেছিলে, ‘আপা খিচুড়ি খাব।’ প্রায়ই এসে ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে তুমি।
এখন আমাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ভীষণ অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সময়টা পার করছি আমরা। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের সন্তানদের দেখলে এখন ভয় লাগে। নিজেদের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তের এ যুদ্ধে জিততে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে হবে।
ইশরাত, তুমিও তো ধর্মকর্ম করতে। তোমার মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেই আমরা তোমাকে বিদায় দিয়েছি। তোমার চলে যাওয়ার কষ্ট তোমার মা কীভাবে সহ্য করছেন, সেটা ভাবতেই আমার চোখ ভারী হয়ে আসে, মন আরও ভারী হয়। তোমার দুই ভাই যে এ কষ্ট কীভাবে সামলেছেন, সেটাও তুমি দেখোনি, ইশরাত। আমি, তুমি, আমরা মুসলমান। ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের আছে। ইসলাম যে শান্তির পথ বাতলে দিয়েছে, আমরাও তো সে পথেই। তবুও কেন ইশরাত, আমাদের সন্তানেরা জঙ্গিবাদের মতো ঘৃণ্য সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে? সত্যিই আমাদের আরও ভাবতে হবে। ষড়যন্ত্রগুলো চারপাশ থেকে আমাদের উন্নয়ন, উত্থান রুখে দিতে চাইছে। এখানে ভয় পেয়ে থেমে গেলে চলবে না আমাদের। তুমি নেই, তোমার না-থাকাকে শক্তি আর সাহসে রূপান্তর করেই এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
তোমার সঙ্গে কত কত স্মৃতি, ইশু। কী অসাধারণ রান্নার হাত তোমার। সেবার তোমার বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলে। ছিমছাম, গোছানো তোমার বাসাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। সেদিন বিদেশি কয়েকজন বন্ধুও ছিলেন সেই দাওয়াতে। সবার সামনে তুমি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছ এই বলে—এটা আমার বড় বোন। কত আন্তরিকতা দিয়ে সেদিন তুমি আমাদের আপ্যায়ন করলে। ইশরাত, সেদিনই আমার মনে হয়েছে—রক্তই যদি সব না হয়, তাহলে তুমিই তো আমার আত্মীয়।
ইশরাত, মনে পড়ে তো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কথা। কোথায় যেন শুনেছিলে আমরা ‘ফ্রি ফ্রাই ডে’ ক্লিনিক করব। তুমি সবার আগে চলে এলে। আমাদের সঙ্গে রওনা দিলে। সারা দিন কত রোগীর যে সেবা করলে তুমি। তুমি সব সময়ই মানুষের জন্য কিছু না কিছু করতে চাইতে।
তুমি তো জানো ইশরাত, গুলশানের হলি আর্টিজানের খুব কাছেই আমার বাসা। সেদিন গুলির আওয়াজগুলো শুনেই আঁতকে উঠছিলাম। খবর পেলাম, ভেতরে তুমিও আটকে আছ। মুহূর্তেই যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। এমন বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। একাত্তরের যুদ্ধ তো এ জন্য হয়নি। আমরা যাদের কোলেপিঠে বড় করে তুলেছি, মানুষ বানিয়েছি, তারাই এখন দেশ ধ্বংসের পাঁয়তারায় মেতেছে? নিজেকেও বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছে।
ইসলাম তো মানবতার ধর্ম, শান্তির ধর্ম। অথচ এরা কিনা ধর্মের দোহাই দিয়েই মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। এদের শোধরানোর দায়িত্ব কারা নেবে? কেবল রাষ্ট্র, নাকি আমাদেরও এ দায়িত্ব আছে?
ইশরাত, তোমরা চলে গিয়ে আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ। এখন আমাদের কাজ অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের তরুণ সমাজকে অন্যায়ের এ পথ থেকে বের করে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের আরও কাছাকাছি পৌঁছাতে না পারলে গভীর শঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। বাংলাদেশকে থেমে গেলে চলবে না; বরং প্রবল শক্তি নিয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষার এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে।
ইশু, হাসছ? তুমি দেখো, আমরা ঠিক ঠিক তোমার স্মৃতিকে ধারণ করে সব শঙ্কা কাটিয়ে উঠব।
ইতি,
শুধু তোমার আপা
সাফিনা রহমান: চেয়ারম্যান, লক্ষ্ম্যা সুয়েটার্স লিমিটেড, সাবেক ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১ এবং সাবেক ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট, জেসিআই