ইশশ, এখানে পুরোনো শাড়ি নতুন জীবন পায়

ফারহানা সালেহ শাড়ি পরতে একটু বেশি ভালোবাসেন। ঠিক কবে থেকে শাড়ি পরতেন, দিনক্ষণের সেভাবে হিসাব নেই। তবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন লেডি শ্রীরাম কলেজে যখন পড়তেন, তখনো প্রায়ই শাড়ি পরতেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) থেকে এমবিএ যখন করছেন, সেই সময় আরেকটু বাড়িয়ে দেন শাড়ি পরার হার। তারপর যেদিন থেকে চাকরিতে যোগ দিলেন, সেদিন থেকে প্রতিদিন শাড়ি পরেন তিনি। একুশ বছর ধরে টানা শাড়ি পরছেন তিনি।

নিজের অফিসের বারান্দায় ফারহানা সালেহ
ছবি: লেখক

শাড়ির সঙ্গে ফারহানার তাই অন্যরকম সম্পর্ক। যত জায়গায় ঘুরতে গেছেন, শাড়ি পরে গেছেন। আবার যেখানে বেড়াতে গেছেন, সুযোগ পেলেই সেখান থেকে স্মৃতিস্বরূপ কিনেছেন শাড়ি। তারপর সেই শাড়ি পরলেই তাঁর মনে পড়ে যায় সেই জায়গার কথা। জীবনে অসংখ্য শাড়ি উপহার পেয়েছেন। অসংখ্য শাড়ি কিনেছেন। এভাবেই তাঁর সংগ্রহে জমা হয়েছে শত শত শাড়ি।

যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজের সামনে ফারহানা সালেহ
ছবি: সংগৃহীত

এত শাড়ি কী করবেন! একমাত্র মেয়ে পড়াশোনা করে ইংল্যান্ডের লন্ডনের কিংস কলেজে। শাড়ি নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ নেই। ফারহানা তাই বুদ্ধি করে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে ‘ইশশ’ নামে একটা পেজ খুললেন। সেখানে নিজের সংগ্রহ থেকে বেশ কিছু শাড়ির ছবি তুলে দিলেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। প্রতিটি শাড়ি একবার বা দুবার পরা। দাম রেখেছেন সর্বোচ্চ কেনা দামের অর্ধেক বা তার কম। ধরুন, একটি শাড়ি আট হাজার টাকা দিয়ে কেনা। সেটি তিনি বিক্রি করেন তিন হাজার টাকায়।

কোরা কাতানের এই শাড়িটি কেনা হয়েছিল ৮ হাজার টাকায়, বিক্রি হয়েছে আড়াই হাজার টাকায়
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

একলা শুরু করলেও পরে ফারহানার সঙ্গে অনেকেই যুক্ত হন। অনেকেই দু–একবার পরা শাড়ির ছবি দেন ফারহানার পেজে। পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে একদিন গিয়ে হাজির হই ফারহানার বনানী ১১ নম্বরের অফিসে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বিশাল ঘরে আলাদা করে নজরে পড়ে একটি পেটমোটা স্যুটকেস। স্যুটকেস ভর্তি শাড়ি। বিস্কুট আর গরম চায়ের ধোঁয়ায় শুরু হলো আড্ডা।

ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা ফারহানা সালেহ
ছবি: ফেসবুক থেকে

এত নাম থাকতে ‘ইশশ’ কেন? ‘শাড়ি যেমন আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িত, তেমনি আমরা কথাবার্তায় খুশি হলে, অবাক হলে, আক্ষেপ বা মিস করলে আনমনেই আমাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ইশশ। এ রকম একটি ভাবনা থেকেই নাম রাখা ইশশ,’ বললেন এই ব্যবসায়ী ও শখের উদ্যোক্তা। বাকি গল্পটাও ফারহানার মুখেই শোনা যাক, ‘এই যে আমার অফিসে ঢুকলেন, এই পুরোটাই আমার কর্মস্থল। আর কোনায় যে স্যুটকেসটা রয়েছে, সেটি আমার শখ। যদি ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম থেকে কোনো শাড়ির অর্ডার আসে, অফিসের সহকারী এখান থেকে পৌঁছে দেন বা কুরিয়ার করেন। শাড়ি অদল–বদল করে পরার যে সংস্কৃতি, আমি সেই পরিসরটাই আরেকটু বড় করতে চেয়েছি। আমি যে শাড়ি বিক্রি করি, এতে কিন্তু আমার কোনো লাভ নেই। পুরোটাই আমার ভালোলাগা থেকে।’

’ইশশ’ এর উদ্যোক্তা ফারহানা
ছবি: লেখক

ফারহানা এখন কেবল শাড়ি বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি ইশশ–এর কার্যক্রম। এখন তিনি শাড়ি কেটে দেশের ডিজাইনারদের দিয়ে বানাচ্ছেন কোটিসহ নানাকিছু। এভাবে তিনি নিজের মতো করে ‘টেকসই সবুজ ফ্যাশন’কে অনুপ্রাণিত করার প্রয়াস নিয়েছেন। ইশশ–এর আগামীর কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘দেখুন, একটি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কত গল্প থাকে। আমি বিশেষ বিশেষ শাড়ির গল্পের ডকুমেন্টেশন করতে চাই। যেমন যাঁর শাড়ি, তিনি হয়তো সেই শাড়িটা নিয়ে বললেন। এটার একটি লিখিত রূপও থাকল। পরবর্তী সময়ে যিনি শাড়িটা কিনবেন, ওই শাড়িতে যোগ হবে তাঁর নতুন নতুন গল্প। এভাবে শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি সংরক্ষণ করার ইচ্ছা আছে।’

শাড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে কোটি, এভাবে ডিজাইনারদেরও যুক্ত করছেন নিজের উদ্যোগের সঙ্গে, এভাবেই বড় হচ্ছে ‘ইশশ’ এর পরিসর
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

কথায় কথায় শাড়ি ‘ইউনিসেক্স’ (নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পরতে পারে) পোশাক কি না, এ বিষয়ে ফারহানার মত জানতে চাইলাম। বললেন, ‘কিছুটা তো বটেই। ছোটবেলায় কিন্তু ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশু যে–ই হোক না কেন, গামছা বা ওড়না পেঁচিয়ে শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আবার ক্লাসিক্যাল নাচের ক্ষেত্রেও কিন্তু নারী–পুরুষ সবাইকেই শাড়ি পরতে হয়। শাড়ি দিয়ে পাঞ্জাবি বানিয়ে পরার চলও রয়েছে। শাড়ি দিয়ে কাঁথা বানালে সেটির তো আর নারী–পুরুষ হয় না।’
ইশশ–এর পাশাপাশি অনলাইনে এখন বেশ কিছু পেজ রয়েছে। সেখানেও ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ শাড়ি বিক্রি হচ্ছে দেদার।

‘ইশশ’–এর পেজে পাকিস্তানী সিল্কের এই শাড়িটি চার হাজার টাকায় বিক্রির জন্য তোলা হয়েছে, শাড়িটি একেবারে নতুনের মতো, কেনা হয়েছিল ১২ হাজার টাকায়
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে