ঈদ আছে কিন্তু নতুন জামা নেই!
তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র (রোল-১, ক শাখা)। পরীক্ষার আগের রাত আর ঈদের আগের রাত ছিল আমার জন্য উত্তেজনার। ঈদের আগের রাতে ঘুম আসত না, শুধু স্বপ্ন আসত। কখন সকাল হবে, কখন নতুন জামা পরব। এখন যেমন ফেসবুকে নিজের জামার ছবি ঈদের সকালে আপলোড দিয়ে আমরা সারা দিন কয়টা লাইক হলো তা গুনি, তখন এমন ছিল না। তখন সকালে একটা জবরদস্ত গোসল দিয়ে নতুন জামাটা পরে আশপাশের অলি গলিতে হাঁটতাম।
সেই সব অলি গলি ছিল আমাদের মতো একদিনের র্যাম্প মডেলদের জন্য এক অলিখিত মঞ্চ। বন্ধুরা তাকাত, কেউ কেউ হিংসায় অসুস্থ হয়ে যেতো, আধা মরা হয়ে যেতো, যদি তার জামা থেকে অন্যের জামা বেশি সুন্দর হতো। এমন যন্ত্রণা আমারও হতো। যদি আমার জামা কম সুন্দর হতো তখন আমারও ইচ্ছে হতো জ্বালিয়ে দিই অন্যের বেশি সুন্দর জামা। নতুন জামার মিষ্টি গন্ধটাও দারুণ ছিল। একটু পর পর নিজের শরীরের জামার গন্ধ নিজেই নিতাম। কিন্তু জিততে হতোই। ক্লাসে সেকেন্ড হতে রাজি আছি কিন্তু ঈদের জামায় হেরে যাব—এ মেনে নেওয়া যায় না।
এই রেষারেষির সূত্র ধরেই আমার ওপর এক অতর্কিত আক্রমণ আসে। আমার জামা জ্বালিয়ে দেয় কেউ? নাহ! তবে ঈদের দিনের এক সকালে আমার জামা চুরি হয়। আমি তখন রেগে আগুন। আমি প্রথমেই সন্দেহ করি, যে ক শাখার রোল-২ তাকেই। কারণ, তার দ্বারাই এমন জঘন্য কাজ করা সম্ভব। কিন্তু আমার কাছে চাক্ষুষ প্রমাণ নেই, আমার কাছে নেই কোনো ব্যক্তিগত গোয়েন্দা সংস্থা। বাসায় সাদাকালো টিভি আছে, কিন্তু সিসি টিভি নেই। যা আছে তা চোখের পানি।
কেঁদেকেটে সারা বাড়ি যখন আমার শব্দদূষণের অত্যাচারে জর্জরিত তখন আমাকে পরিবারের আপনজনেরা নিজ উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী কাপড়ের দোকানে নিয়ে গেল। কিন্তু সেখানে না আছে কোন দোকানি আর যে দোকানি আছে তিনি আতর বিক্রিতে ব্যস্ত। আমি কি সারা শরীরে আতর মেখেই ঈদ করব এবার? শেষমেশ কোনো কিছুই পাওয়া গেল না। কাপড় ধোয়ার সাবান বাসায় নিয়ে গিয়ে কাপড় নতুন করে ধোয়া অথবা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর উপায় নেই। আরেকটা উপায় আছে, অসুস্থ হওয়ার ভান ধরা। কিন্তু সেই ভান ধরতে গেলেও তো বন্ধুরা আমাকে দেখতে আসবে। এসে বলবে, ‘ইস রে! নতুন জামাটা আজ পরতে পারলি না। দেখি কই নতুন জামা!’
বাসায় ফিরে রুম তন্ন তন্ন করে আবার খুঁজলাম। যদি পেয়ে যাই। শুধু খাটের নিচ না, আমার ব্যাট বল স্ট্যাম্প নেড়ে চেড়েও দেখলাম। যদি কোনো জাদুর কাঠি ম্যাজিক চকের মতো এগুলোর আশপাশে লেগে থাকে।
ততক্ষণে আমার বন্ধুরা তাদের মডেলিং শুরু করে দেয়। আজ তাদের সবাইকে বানর বানর লাগছে। তারা আমার সামনে এসে খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে। তাদের এই অভিনয় আমাকে বিমোহিত করে। কান্না বাদ দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমি শুধু বলে যাচ্ছি, আমি একটু পরে গোসল করে জামা পরব। আমার সত্য শুধু আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানেন। এমন দুঃখের মুহূর্তে তবু আমি গোসলে যাই। এই ঈদে আমি হার মেনে নিই।
সামনের ঈদের জন্য নিজেকে নতুন করে প্রস্তুত করার উৎসাহ নিতে থাকি নিজে নিজে। কিন্তু ততক্ষণে আমার জামা উদ্ধার হয়। আমার সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে জামা চুরি করে আমাদের বাসার বুয়ার ছেলে। সেই ছেলে এই ঈদের জামা পেয়েছিল। কিন্তু তার জামা থেকে আমার জামা বেশি সুন্দর হওয়ায় সে এই চুরির সিদ্ধান্ত নেয়। আমি রাগ করিনি, আমি সেদিন আর কোনো মডেলিংও করিনি। আমি আর সেই ছেলে মিলে সেদিন দুজনের জামা অদলবদল করে পরেছি।