ঈদ মানেই ছেলেবেলা
ঈদ মানে নিজের পরিবার, সন্তান, নাতিপুতি, ভাইবোনের বিশাল এক জগৎ। তারপরও আমার কাছে ঈদ মানেই ছেলেবেলা। তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে সেই ১৫–২০টি বাড়ির একটা ছোট্ট পাড়া আর আব্বা–আম্মার মুখ
আমাদের বাসা ছিল তেজগাঁও স্টেশনের কাছে। তখন এটি ছিল ১৫–২০টি বাড়ির ছোট্ট একটি পাড়া। সবাই সবাইকে চেনেন। দারুণ আন্তরিক পরিবেশ। সময়টা গত শতকের পঞ্চাশের দশক। সেই সময়ে ঈদ মানেই ছিল নতুন জামাকাপড়। ঈদের জামার জন্য রমজানের প্রথম থেকেই শুরু হতো অপেক্ষা। দিন গুনতাম, কবে নতুন জামা কিনে আনবেন বাবা। সেই জামা হাতে পাওয়ার পর আরেক ভাবনা, চাঁদরাত পর্যন্ত কোথায় লুকিয়ে রাখব! আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন। সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেও কীভাবে কীভাবে যেন আমাদের বড় বোন (রওশন আরা) সেই পোশাক দেখে ফেলত। সেই নিয়ে ঝগড়া করে পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেলতাম।
সালামির চল তখনো সেভাবে শুরু হয়নি। তাই আমাদের মতো ছোটদের কাছে পোশাকই ছিল ঈদের প্রধান আকর্ষণ। সেই বয়সে নতুন জামাকাপড় পরে বেলায় বেলায় সবাইকে দেখানোর মধ্যেই যেন ঈদের সব সুখ। মূলত স্বাধীনতার পর থেকে সালামির চল শুরু হয়েছে। তবে ঈদের দিন আম্মা–আব্বার কাছ থেকে একটা খরচ পেতাম। ঈদের দিন সকালে আব্বার হাত ধরে নামাজ পড়তে যেতাম। ফিরে এসে আব্বা ও মাকে সালাম করতাম। তখনই খরচাটা দিতেন তাঁরা।
একটু যখন বড় হতে শুরু করলাম, ঈদের আনন্দও ধীরে ধীরে ভিন্ন রকম হতে শুরু করল। চলচ্চিত্রে ব্যস্ততা বাড়ার পর থেকে তো শুধু প্রাণভরে ঘুমাতে পারব—এ জন্য ঈদের অপেক্ষা করতাম। কাজের ব্যস্ততায় ঠিকমতো ঘুম হতো না। তাই ঈদের ছুটি মানেই কয়েক দিনের আরামের ঘুম। তবে সকালে ঈদের নামাজ, বিকেলে বন্ধুদের আড্ডা—এসবও চলত। অভিনয় শুরু করার পর থেকে তো আমাদের দিলু রোডের বাসা ও পরে উত্তরার বাড়িতে প্রতি ঈদে বিকেলের পর থেকে অঘোষিত পার্টি হতো। কোনোবার ১০০–১৫০ জনের কম হতো না। সহকর্মীদের অনেকেই আসতেন। এ ধারা চলেছে অনেক বছর পর্যন্ত।
একসময় নিজে বাবা হলাম। সন্তানের জন্য নতুন পোশাক কেনার মাধ্যমে ঈদের আনন্দ পেতে শুরু করলাম। এখন তো নাতি–নাতনিদের জন্য কেনাকাটা করি। ঈদের দিন তারা বাসায় আসে। সালামি চায়, সেসব নিয়ে খুনসুটি হয়। ভালোই লাগে ঈদের এ ছোটখাটো বিষয়গুলো।
আগে ঈদের দিন সব ভাইবোন একসঙ্গে কাটাতাম। বড় বোন ১৫–১৬ বছর হলো আমেরিকাপ্রবাসী। গত বছর পর্যন্ত ছোট বোনের (হোসনে আরা ওরফে রিনা) বাসায় বেড়াতে যেতাম ঈদের পরদিন। কিছুদিন আগে বোনটাও মারা গেছে। খুব ভালো রান্না করত রিনা। ওর হাতের গরুর রেজালা আমার খাওয়া সেরা পদ বললেও ভুল হবে না। সেই রান্নাও এবার মিস করব।
আগে ঈদের দিন সব ভাইবোন একসঙ্গে কাটাতাম। বড় বোন ১৫–১৬ বছর হলো আমেরিকাপ্রবাসী। গত বছর পর্যন্ত ছোট বোনের (হোসনে আরা ওরফে রিনা) বাসায় বেড়াতে যেতাম ঈদের পরদিন। কিছুদিন আগে বোনটাও মারা গেছে। খুব ভালো রান্না করত রিনা। ওর হাতের গরুর রেজালা আমার খাওয়া সেরা পদ বললেও ভুল হবে না। সেই রান্নাও এবার মিস করব।
এখন ঈদের আগে সময় পেলে রুনার (লায়লা) জন্য কেনাকাটা করি। রুনাও আমার জন্য এটা–সেটা কেনে। তবে সেটা ঠিক ঈদ উপলক্ষে না, হয়তো আমি কোথাও গেলাম, ওর জন্য কিছু কিনে আনলাম। সে–ও এভাবে যেটা ভালো লাগে আমার জন্য কিনে আনে। সেসব থেকেই ঈদের দিনে পরার মতো কিছু পাওয়া যায়।
ঈদের সকালে এখন নাশতা আর নামাজের পর একটা ঘুম দিই। দুপুরে সন্তান ও নাতিপুতিদের সঙ্গে খাই। বিকেলে এখনো অনেকে দেখা করতে আসে। গল্প, আড্ডা জমে।
এত বছর অভিনয় করলেও শুটিংয়ের জন্য কখনো ঈদের সময় দেশের বাইরে কাটাতে হয়নি। এটা আমার জন্য বিরাট ভাগ্যই বলতে হবে। পরিবার–পরিজনের সান্নিধ্যে থাকার মধ্যেই তো ঈদের খুশি। এখন তো ঈদ মানে নিজের পরিবার, সন্তান, নাতিপুতি, ভাইবোনের বিশাল এক জগৎ। তারপরও আমার কাছে ঈদ মানেই ছেলেবেলা। তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে সেই ১৫–২০টি বাড়ির একটা ছোট্ট পাড়া আর আব্বা–আম্মার মুখ।