উগ্র আচরণ কেন?

আপনার উগ্র আচরণের কারণে সরে যেতে পারে কাছের বন্ধুটিও। মডেল: আয়াজ ও রাফি  ছবি: সুমন ইউসুফ
আপনার উগ্র আচরণের কারণে সরে যেতে পারে কাছের বন্ধুটিও। মডেল: আয়াজ ও রাফি ছবি: সুমন ইউসুফ

জীবনে চলার পথে আশপাশে, কর্মস্থল এমনকি নিজ ঘরেও দেখা যাবে কারও কারও খুব উগ্র মেজাজ। মনের অজান্তেই কি হঠাৎ খুব বদমেজাজ? চারপাশের পরিবেশ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তবু একসময় এ যেন অভ্যাস হয়ে যায়।
ঘরে মেয়ে বড় হয়ে উঠছে, লক্ষ করলেন মা-বাবা তার মেজাজে হঠাৎ পরিবর্তন। খুব উগ্র, উদ্ধত, আগে এমন ছিল না। নিজের যা ইচ্ছে করছে, কথা শোনে না। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে চরম অশান্তি করে। ঘরে উগ্র ব্যবহার চলল, এরপর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে শুরু হলো।
বেশ কিছুদিন ধরেই এ রকম হতে হতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, মা-বাবা এখন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অসহায় বোধ করছেন, এমনটা হতে পারে। পরিবর্তনটি সম্প্রতি ঘটলে এমন হতে পারে সন্তানের মনে কোনো কারণে বিষণ্নতা ভর করেছে। কিংবা অন্য কোনো কারণ। তাই সাইকিয়াট্রিস্ট ভরসা। প্রয়োজন হতে পারে কাউন্সেলিং।
কেবল তা-ই কেন? অফিসে উদ্ধত সহকর্মী। অকারণে রাগারাগি, উগ্র মেজাজ—এ রকম ঘটনাও ঘটে।
আমাদের বেশির ভাগ মানুষের অন্যকে কোনো কারণে সামান্য মেজাজ দেখাতে হয়, উগ্র হয়ে ওঠা তখন হয়তো ক্ষণিকের, ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গেই এমন ঘটে। হঠাৎ হঠাৎ রুক্ষ মেজাজ দেখানো, কখনো শিশুসুলভ মনে হতে পারে। কখনো হয়তো স্বার্থপরের মতো আচরণ মনে হতে পারে। খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু কখনো কখনো এসব আচরণ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ব্যাপার। হয়তো আমরা আবেগের ব্যাপারে পরিপক্বতা অর্জন করতে পারিনি বা মা-বাবা সন্তানকে সেভাবে লালন-পালন করতে পারেননি।
কেন উগ্র আচরণ করে মানুষ?
আমি সব জানি, আমি যা বলি সব ঠিক—এমন মনোভাব অনেক সময় উগ্র মেজাজ দেখানোর কারণ হতে পারে। তা হবে কেন? বুঝতে হবে বিনয়ের সঙ্গে প্রচুর আত্মবিশ্বাস অন্যের আকর্ষণের কারণ হয়। কেউ নিচু হতে চায় না অন্যের চেয়ে, প্রত্যেকের কাছ থেকেই জীবনে কিছু শেখার থাকে।
বদমেজাজ ক্ষণে ক্ষণে ভালো নয়। আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় রাগি, আহত হই—এ অস্বাভাবিক নয়, রাগের প্রকাশ হবেই তো। কিন্তু তা অভ্যাসে দাঁড়াবে কেন?
তাই ক্রোধ বা হতাশা যখন হয় তখন এর উৎস খোঁজা ভালো। হয়তো কারণ অনেক গভীরে। গভীর শ্বাস নিন, শান্তভাবে তখনকার অনুভূতির কথা বলুন। মনঃসমীক্ষকের পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় অন্যদের সঙ্গে গুজব শুনে মেজাজ খারাপ। নিজেকে এতে জড়ানো ঠিক না।
উগ্র মেজাজ যা কেড়ে নেয় জীবন থেকে—
যাদের এমন মেজাজ, তাদের যে কী ক্ষতি হয় তা যদি তাদের জানা থাকত।
প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
মানুষ দূরে সরে যায়।

.
.

কীভাবে বেরিয়ে আসবেন
টিনএজে সন্তানের উগ্র আচরণ হতে পারে। দুর্বিনীত আচরণ, অসংযত খেয়াল টিনএজে বেশি। কিন্তু অনেকে এ থেকে বেরিয়ে আসে ভালো প্যারেন্টিংয়ের জন্য বা কোনো সময় কোনো শক্তির বলেও বেরিয়ে আসে। হয়তো এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে শিল্পকলা, কবিতা বা বইপড়ার নেশা, ভ্রমণ, কারও ক্ষেত্রে ক্রিকেট। টিনএজে মগজে ঘটে পরিবর্তন, তবে পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলেই। জীবনপথে অভিজ্ঞতায় মগজের পরিবর্তনের রদবদল ঘটে যায়। প্রকৃতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ লালন-পালন। ‘নেচার ও নারচার’। তাই বিভ্রান্তিতে, মেজাজের এই উত্তাল অবস্থায় দিশা দেখাতে পারেন মা-বাবা, গুরুজন, শিক্ষক। সবার প্রচেষ্টায় নিহিত হবে বিক্ষিপ্ত সময়টা, উগ্র মনটা হবে শান্ত। অভিভাবকের স্নেহ-মমতা ভরা নিরাপত্তা ও আশ্বাস, নির্ভরতা—এভাবে টিনএজ থেকেই বড় হয়ে ওঠে সন্তান, বড় হয়ে সে দুর্বিনীত ও উদ্ধত আচরণ করে না। আমরা যেভাবে চাই, তা কি সব সময় ঘটবে? অন্যদের নিজের পছন্দ আছে, নিজস্ব ভাবনা আছে, এটি বুঝতে হবে। তাই সবকিছু নিজের মনমতো চলবে না, তা গ্রহণ করতে হবে। আমার হয়তো পছন্দ নয়, তবু অন্য কারও নিজ পছন্দ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। নিজের যা চাই তা প্রকাশ করলাম, নিজের চাহিদা বিনীতভাবে জানালাম, হতাশাকে উদার মনে গ্রহণ করলাম।
যে পেশাতে তরতরিয়ে ওঠার কথা ছিল দক্ষতার কারণে, কেবল বদমেজাজে সে জন্য তা থমকে দাঁড়ায়, জীবনে অশান্তিও হয় কম না।
ঈর্ষা অনেক সময় উগ্র মেজাজের জন্ম দেয়। একে সামলানো উচিত। আবার শৈশবে আচার-ব্যবহার শেখা হলেও বড় হয়ে অনেকের মধ্য থেকে কি সে শিক্ষা উবে যায়? ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি বলা, নিচুস্বরে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা, অন্যের কথার মধ্যে বাধা না দেওয়া, আলাপ করা, অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করা, খেতে বসে শিষ্ট আচরণ করা—এসব কিছু আচরণ মানুষকে বুঝতে দেয় আপনি অন্যকে মূল্যায়ন করেন, সম্মান করেন, মর্যাদা দেন।
ভালো মেজাজ কী, ভালো ও শিষ্ট আচরণ কী আমরা জানি। হয়তো সমাজ এসব নিয়ম-আচার পালনের প্রতি অতটা কঠিন নয়, আবার হয়তো একে প্রশ্রয়ও দেয়। আয়নায় নিজের মুখ দেখা অনেক সময় কঠিন কাজ, আমরা যখন উগ্র মেজাজ করি। সে চেহারা দেখতে যেন চায় না। আমরা নিজেদের এমন আচরণকে প্রশ্রয় দিই, এর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চেষ্টা করি। কিন্তু নিজের উন্নতি, সংসারে শান্তি আসে; যদি নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি বুঝে একে সংশোধন করি, বদলে ফেলি আচরণটা। আমরা তখন হব সবার প্রিয়জন।

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী : পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বিভাগ বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা