একজন রিকশাওয়ালা

তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে। এক পরিচিত মানুষের বাসায় খাট পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল কাঁধে। না করতে পারিনি। সন্ধ্যায় টিউশনি থেকে ফিরে দায়িত্ব পালনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু খাট তো আর মাথায় করে নিতে পারব না! এক রিকশাচালককে ডাকলাম, ‘চাচা, টিটিসি মোড় যাবেন? একটা খাট নিয়ে যাব।’ তিনি এক শব্দে উত্তর দিলেন, ‘যাব।’
খাটটা রিকশায় তুলে দেখি আমার আর বসার মতো জায়গা নেই। তাঁকে বললাম, ‘চাচা, আপনি টিটিসি মোড় আসেন, আমি অটোতে করে যাচ্ছি।’ তিনি হ্যাঁ-সূচক সায় দিলেন। অটোরিকশায় উঠে আমি তাঁর পেছনে পেছনেই যাচ্ছিলাম। খানিকটা পথ যাওয়ার পর হঠাৎ রিকশা কাত হয়ে তিনি নিচে পড়ে গেলেন। আশপাশের মানুষের সহযোগিতায় তাঁকে তোলা হলো। রিকশাচালক রক্তাক্ত হননি, তবে আঘাত পেয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, ‘চাচা, না পারলে থাক। অন্য কাউকে দিয়ে নিয়ে যাব।’ তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘এইডা কোনো ব্যাপার না। পারুম বাজান, চলেন।’
মানুষটার দৃঢ়তা দেখে অবাক হলাম না। কারণ, এভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে না পারলে নিশ্চয় অভুক্ত থাকতে হবে পরিবারের সদস্যদের। বললাম, ‘ঠিক আছে চাচা, আপনি আসেন, আমি অটোতে যাচ্ছি, টিটিসি মোড়ে অপেক্ষা করব।’
টিটিসি মোড় গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই তিনি এলেন। খাটটা আমার পরিচিত মানুষের বাসায় পৌঁছে দিলাম। তখন সন্ধ্যার পর টিটিসি মোড়ে তেমন রিকশা বা অটো পাওয়া যেত না। তাই তাঁকে নিয়েই শাপলা চত্বর এলাম। পথে হঠাৎ রিকশাচালক চাচা বললেন, ‘পিঠে বড় ব্যথা পাইছি, বাজান। একটা ট্যাবলেট কিন্না খাইতে হইবো।’ আমার নীরবতা দেখে তিনি আবার বললেন, ‘এ রকম আরও কত ব্যথা পাইছি বাপ, এইডা কিছু না।’ আমার আফসোস হতে লাগল। তিনি আবার সংকোচে কিছু বলতে চাইছিলেন। আমি বাধা দিলাম না। তিনি আবার বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘টেকাডা একটু বাড়াইয়া দেও।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘কত দেব বলেন, ৫০ টেকা।’ টিটিসি মোড় থেকে শাপলা চত্বর বেশি দূরে নয়। খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলাম। আমি তাঁকে ৬০ টাকা দিলাম। তখন রিকশাওয়ালা চাচার মুখে যে হাসি দেখলাম, তা পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে হার মানায়। তাঁরা অল্পতেই অনেক খুশি। আসার সময় বারবার তিনি একটা কথাই বলে যাচ্ছিলেন, ‘পিঠে বড় ব্যথা পাইছি, বাজান।’ বাসায় আসতে আসতে সেই কথাটা বারবার আমার কানে ভাসতে লাগল, ‘পিঠে বড় ব্যথা পাইছি, বাজান।’
আবার তাঁকে পেয়েছিলাম এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাসার সামনে। ওই দিন সে পরিবারের একটা অনুষ্ঠানে অনেক লোকের নিমন্ত্রণ ছিল। আমিও নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, তাই আহার সেরে বের হতেই সেই রিকশাওয়ালা চাচার সঙ্গে দেখা। ভাত খেয়েছেন কি না, জিজ্ঞাস করতেই সেই ম্লান হাসি। এই ম্লান হাসিতে পেলাম না সেই সৌন্দর্য। আমরা কি পারি না কোনো অনুষ্ঠানে এসব মানুষকে দুমুঠো খাওয়াতে। ওরা তো অল্পতেই অনেক খুশি। একবার চেষ্টা করে দেখি, কত ম্লান হাসিতে ওরা ভরিয়ে দেবে আমাদের, কল্পনাও করতে পারব না।
সজীব চক্রবর্তী