একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া

এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ​সৌন্দর্যচর্চা ও পার্লার ব্যবস্থাপনা কোর্সের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। ছবি: সাহাদাত পারভেজ
এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ​সৌন্দর্যচর্চা ও পার্লার ব্যবস্থাপনা কোর্সের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। ছবি: সাহাদাত পারভেজ

মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে ২০০২ সালে জামালপুরের দেলুয়ারা বেগম শুরু করেন বুটিক হাউস ‘দীপ্ত কুটির’। তখন তাঁর পোশাকের কারখানায় কাজ করতেন পাঁচ-ছয়জন নারীকর্মী। আজ সেখানে ৪০ জন নারী। সব মিলিয়ে তাঁর ব্যবসায়ের মূলধন বর্তমানে তিন কোটি টাকার মতো।

মূলত ব্লকপ্রিন্ট, থ্রিপিস, চাদর, নকশিকাঁথা, ব্যাগ তৈরি করে জামালুপর শহরের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় পণ্য সরবরাহ করেন দেলুয়ারা বেগম। এ ছাড়া নেপাল, চীন ও ভারতে অল্পবিস্তর রপ্তানিও করছেন। তিনি তাঁর পণ্য নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে মেলায় অংশ নিয়েছেন। ২০১২ সালে জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছেন এই সফল উদ্যোক্তা।

জামালপুর থেকে মুঠোফোনে ১ অক্টোবর দেলুয়ারা বেগম বললেন, ‘অনেক দিন থেকে ব্যবসা করলেও পণ্যের বিপণন বিষয়ে কিছুই জানতাম না। ২০১২ সালে আমি এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে এক সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ করে শিখলাম বিপণন বিষয়ে। সেটিই আমার ব্যবসা বড় করতে অনেক সহায়তা করল।’ দেলুয়ারার গড় বিক্রির পরিমাণ প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

দেলুয়ারা বেগমের মতো শত শত ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাকে সফল হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশন সারা বছরই বিভিন্ন বিষয়ে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানালেন, ফাউন্ডেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন চেম্বারের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থাও করেছে ফাউন্ডেশন। নারী উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দিতে ২০০৮ সাল থেকে দুই বছর পরপর জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার দিয়ে আসছে এসএমই ফাউন্ডেশন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৯০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অবশ্য নারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুরুষ উদ্যোক্তাদের নিয়েও কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান।

ফাউন্ডেশন থেকে বেশ কয়েকবার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এমন আরেক সফল উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহাব। লেদার টেকনোলজি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে তানিয়া ২০০৫ সালে ঢাকার হাজারীবাগে ব্যবসা শুরু করেন। একজন শ্রমিক ও ১০ হাজার টাকা মূলধন—এই নিয়ে শুরু করেন নিজের উদ্যোগ ‘কারিগর’। প্রতিষ্ঠানটি চামড়া, রেকসিন ও পাট দিয়ে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্য উপহারসামগ্রী তৈরি করে।

তানিয়া ওয়াহাব বললেন, ‘নিজের ওপর আমার আত্মবিশ্বাস আছে। প্রথম যখন ব্যবসা শুরু করি, তখন অনেকেই নেতিবাচক কথা বলেছে। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি কাজ দিয়েই তাদের জবাব দেব। সেটিই করেছি।’ জানালেন, বর্তমানে কারিগরের করপোরেট গ্রাহকের মধ্যে আছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ ও গ্রামীণফোন। এ ছাড়া আড়ং ও ক্রে ক্রাফটের জন্য হস্তশিল্প তৈরি করা হয়। সম্প্রতি কানাডায় জ্যাকেট ও প্যান্ট রপ্তানির একটি ক্রয়াদেশ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তানিয়া ২০০৮ সালে জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছেন।

কথা প্রসঙ্গে তানিয়া জানালেন, বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি এসএমই ফাউন্ডেশনের আয়োজিত কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন কয়েকবার। আরও জানান, এখন তাঁর কারখানায় ৩০-৪০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। এ ছাড়া অনিয়মিত কাজ করেন অনেক শ্রমিক। যেমন গত দুই মাসে এক হাজার শ্রমিক অনিয়মিতভাবে কাজ করেছেন। বর্তমানে ব্যবসার মূলধন প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

>

রোকিয়া আফজাল রহমান
রোকিয়া আফজাল রহমান

আরও বেশি কিছু করার আছে
রোকিয়া আফজাল রহমান
সহসভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
বর্তমানে যেসব কাজ করছে, তার চেয়ে আরও বেশি করতে পারে এসএমই ফাউন্ডেশন। এখানে পর্যাপ্ত তহবিল আসছে না। সে জন্য ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। কাজ হলেই বেশি তহবিল আসবে। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণকে আরও কার্যকর করতে গবেষণা হওয়া দরকার। কোথায় এবং কাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সেটি গবেষণার মাধ্যমে বের হয়ে আসতে পারে। কারণ, নারী উদ্যোক্তাদের বুটিকের প্রশিক্ষণ দিয়ে আর খুব বেশি দূর কিন্তু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। ভারতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) অনেক কাজ হয়। ওখানে গিয়ে কিছু দক্ষ লোক নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য ফাউন্ডেশনের কাজ করা দরকার। তা ছাড়া এসএমই ফাউন্ডেশন এক অঙ্কের সুদ হারে যে পরিমাণ ঋণ দেয়, সেটি খুবই অপ্রতুল। এই পরিমাণ না বাড়াতে পারলে তেমন একটা উপকার হবে না। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৬৯ জন নারী উদ্যোক্তা ৯ শতাংশ সুদে ফাউন্ডেশনের দেওয়া পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের ঋণ পেয়েছেন। তবে আমার কাছে সুদ হারের চেয়ে এসএমই ঋণ তিন লাখ নারী উদ্যোক্তা পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নারী উদ্যোক্তারা একটা পর্যায়ে এসে আটকে গেছেন। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে নারী উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেমন পোশাকশিল্পের জন্য দরকারী ডাইং ও ওয়াশিং প্ল্যান্টও এখন নারীরা করতে পারেন। এ জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন ভালো ভূমিকা নিতে পারে। তবে এ কথাও সত্য, জমি পাওয়া এখন খুবই মুশকিল। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের বিদেশে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মেলায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সে জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ছাড়ে স্টল ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিতে পারে।

এসএমই ফাউন্ডেশন নতুন ব্যবসা সৃষ্টি, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, বিউটিফিকেশন ও পার্লার ম্যানেজমেন্ট, বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি ও বিপণন, ফ্যাশন ডিজাইন ও পোশাক তৈরি, বেসিক মার্কেটিং ও অ্যাকাউন্টিং, ডে-কেয়ার সেন্টার, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্পসহ মোট ৩৭টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। অবশ্য সব সময় সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ হয় না। চাহিদা অনুযায়ী করা হয়। প্রশিক্ষণ সাধারণত ৫ থেকে ১৫ দিনের হয়ে থাকে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রশিক্ষণ) মো. আবদুস সালাম সরদার নারীমঞ্চকে বলেন, চলতি অর্থবছরে ফাউন্ডেশন মোট ১৪ বিষয়ে ১০৫টি প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে সারা দেশে। এর মধ্যে ফাউন্ডেশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৫৫টি এবং চেম্বার ও ব্যবসায়িক সংগঠনের মাধ্যমে করা হবে ৫০টি। সাধারণত জুলাই ও ডিসেম্বরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আবেদনপত্র নেওয়া হয়।

এদিকে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ দিতে এসএমই ফাউন্ডেশন ‘ক্রেডিট হোলসেলিং’ নামে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর আওতায় উদ্যোক্তাদের ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঋণসুবিধা দেওয়া হচ্ছে। যেমন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, মাইডাস ফিন্যান্সিং ও আইডিএলসি। এর মধ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ‘গুণবতী’ ও ট্রাস্ট ব্যাংক ‘সুকন্যা’র মাধ্যমে শুধু নারীদের ঋণ দিচ্ছে।

ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সুমন চন্দ্র সাহা বলেন, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯০৬ জন এসএমই উদ্যোক্তাকে ৪০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে শুধু নারীদের দেওয়া হয়েছে ১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ৩৬৯ জন এসএমই নারী উদ্যোক্তা এই পরিমাণ ঋণ পেয়েছেন।

২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ মো. এহসানুল করিম। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য নারীরা আগে প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকে গিয়ে ঋণ খুব একটা নিতেন না। তবে এখন সেটি হচ্ছে। আর এর পেছনে এসএমই ফাউন্ডেশনের বড় ভূমিকা আছে।’

সদ্য বিদায়ী এই এমডি বলেন, ‘এসএমই ফাউন্ডেশনের তহবিল নিয়ে কিছুটা সংকট আছে। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাজ থেকে একটি বড় ঋণসহায়তা পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। সরকারও নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে।’ চলতি বছর দেশের নারী উদ্যোক্তাদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য একটি জরিপ হওয়ার কথা। সেটি হলে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে নতুন কিছু কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব হবে।