একদিন একদিল আসরে

সড়কঘেঁষা ছোট উঠান। পুরো উঠান ঢাকা নারকেলগাছ আর কাঁঠালগাছের ছায়ায়। দুপুরের খররোদেও জায়গাটা বেশ আরামদায়ক। উঠানের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। চটের ওপর কায়দা করে বিছানো কাঁথা। সেটাই মঞ্চ। সেখানে বসেছেন চারজন। একজন ঢুলি, একজন বয়াতি আর বাকি দুজন দোহার। তাঁদের ঘিরে অভিনয় ও গান করছেন তিনজন। আসর ততক্ষণে শুরু হয়েছে। উঠানজুড়ে থাকা মানুষ মশগুল ‘একদিল’ গানের আসরে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম পাথরের চর। এই গ্রামেরই নজরুল ইসলামের বাড়ির উঠানে বসেছিল এই আসর। ২৯ জুন সে আসরের একজন দর্শক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
একদিল হচ্ছে মানতের গান। সাধারণত বাসনা পূরণের জন্য সত্যপীরের নামে মানত করা হয়। তারপর পেশাদার বয়াতি ডেকে গাওয়া হয় সত্যপীরের বন্দনাগীত। পালন করা হয় লৌকিক আচার-রীতি। জামালপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলার চরাঞ্চলে এখনো এই একদিল গানের আসর বসে।
গান-সংলাপে উপাখ্যান বয়ান
পাথরের চরের ইউসুফ আলীর পরপর দুই মেয়ে হয়েছে। তাঁর ও তাঁর পরিবারের চাওয়া, একটা ছেলেসন্তানের। এ জন্যই এই গানের আসর। বন্দনাগীতি ও পরিচয়পর্ব শেষে আসর তখন জমে উঠেছে।
বয়াতি গান ধরেছেন, ‘ও দাদার বউ হারাইছে/ একে তো অাঁটকুড়ে বিবি/ হাট-বাজারে যায়/ হাট-বাজারে যাইয়ে বিবি/ চড়থাপ্পড় খায়’। গানের সুরের তাল মিলিয়ে অভিনয় করছেন দুজন। তাঁদের একজন সেজেছেন নারী। পরনে ছাপা শাড়ি, লাল ব্লাউজ, হাতে চুড়ি, গলায় চেইন, মাথায় লম্বা কালো পরচুলা আর জরির একটা লাল ঘাগড়া। তিনি আশেক নূরী নামে এক নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চরিত্রই একদিল গানের প্রাণ। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: জামালপুর বইয়ে এই একদিল গান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। বইয়ে বলা হয়েছে, এই নারী ছিলেন নিঃসন্তান। অনেক তপস্যার পর তাঁর সন্তান হয়। সেই সন্তানের নামই সত্যপীর। গানে ও সংলাপে আশেক নূরী নামে এই নারীর সন্তান লাভের উপাখ্যান বয়ান করা হয়।
সত্যপীরের এ পালাগানে আছে, তাঁর মা আশেক নূরী একসময় সন্তানের আশায় রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যান। মুসা নবীর সঙ্গে দেখা করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন। এভাবে ৩৬ বছর সাধনা করে সত্যপীরের মা হন।
নৃত্যগীতে আর সংলাপে সত্যপীরের জন্মকাহিনি—বয়াতি ও দোহাররা পালাগানে ফুটিয়ে তুললেন। আরো কাহিনির নাচ–গানও দেখা হলো বয়াতি বাজনার তালে তালে নাচে ও গানে মাত করলেন উপস্থিত শ্রোতাদের। তাঁর বর্ণনা বড়ই রসসিক্ত, পরিবেশনা কৌতুকময়। অনেক সময় না হেসে পারা যায় না।
এভাবেই ঘণ্টা তিনেক চলে আসর। শেষ দিকে আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের কাছে লালসালু ধরেন দুজন। উপস্থিত মানুষ তাঁদের মানতের টাকাপয়সা সত্যপীরের উদ্দেশে দান করেন। এভাবেই শেষ হয় আসর।

আসরের আগে আচার-রীতি
আসরে সত্যপীরের জন্মকথা বয়ান করা হয়। কিন্তু তার আগে পালন করা হয় কিছু লৌকিক আচার-রীতি। সেসবের দেখা মিলল মঞ্চের পাশে রাখা জলচৌকিতে। এই জলচৌকিতে রাখা হয়েছে একটা কুলা ও চালুনি। কুলাতে চাল রাখা হয়েছে, আছে লাল কাপড় দিয়ে বানানো একটা প্যান্ট। চালুনিতে এক কাঁদি কলা, একমুঠো খই, ধান, দূর্বা, সিঁদুর মাখানো পান। জলচৌকির পাশে একটা মাটির ঘটিতে রাখা হয়েছে পানি। সেই পানিতে পাতাসহ আমের ছোট ডাল ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। এই পানিই নাকি পান করানো হয়। আসর শুরুর আগে চলে এই আচার আয়োজন।
বিশ্বাস আছে, বিশ্বাস নেই
আসরের ইতি টানা হয়েছে। দর্শক-শ্রোতারাও বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের আরও কিছু আচার-রীতি তখনো বাকি ছিল। আধঘণ্টা পর দলটার দুজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। আবদুল মজিদ ও ইলিয়াছ মিয়া এই দলের সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর ধরে যুক্ত। আব্দুল মজিদ জানালেন, তাঁদের দলটা আটজনের।
তাঁর কাছেই একদিল গানের আদ্যোপান্ত শুনতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘বাপু, এই গান তো আমরা মুখে মুখে শিখছি।’ তবে তিনি তাঁর শোনা কথায় পালাগানের উৎপত্তির ইতিহাস বললেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী কী বিষয়ে আপনার পালাগান করা হয়? তিনি বলেন, ‘গরুর বাছুর না হওয়ার যেমন পালা আছে, তেমনি পুনাই (সন্তান) না হওয়ারও পালা আছে।’ আমাদের কথা আরও খানিকটা এগোল। মোদ্দা কথা, এই গানের সাতটি পালা আছে। যে যেটার জন্য মানত করে সেখানে গিয়ে সেটাই গাওয়া হয়। সন্তান লাভ, রোগব্যাধির উপশম, অধিক ফসল উৎপাদন, গোজাতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি—এমন সাত ধরনের মনোবাসনা পূরণের জন্য পালাগান হয়।
দলের সব সদস্যই অন্য কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত। কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউ বা কৃষক। তবে ডাক এলেই ছুটে যান পালা গাইতে। কেমন ডাক আসে এখন? পাশে বসা ইলিয়াছ মিয়া বলেন, ‘এডা বলা মুশকিল। কখনো মাসে চারটাও আসে। কখনো আবার ছয় মাসে একটাও আসে না।’ তাহলে কি মানুষ আর আগের মতো একদিল গানে বিশ্বাস করে না? দুজনই যে উত্তর দিলেন তার অর্থ দাঁড়ায়, মানুষ এখন এসব খুব একটা মানে না। তবে তাঁরা নিজেরা বিশ্বাস করেন বলেই চর্চাটা ধরে রেখেছেন।

তাঁদের দুপুরের খাওয়ার ডাক পড়েছে। ওঠার মুহূর্তে জানতে চাইলাম, এক আসর পালা গাইলে কত টাকা সম্মানী পান? আবদুল মজিদ জানালেন, মানুষের আর্থিক অবস্থার ওপর তাঁরা সম্মানী নেন। সেটা দুই হাজার থেকে আট হাজারও হয়ে থাকে।
তাঁরা বিদায় নিলেন। পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন মানতকারী ইউসুফ আলীর বড় ভাই মোস্তফা আলী। তিনি বললেন, ‘আমাদের এলাকায় এই একদিল গান যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আমার ভাইয়ের শাশুড়ি মানত করেছিলেন। তাঁর আগ্রহের কারণেই আয়োজন করা হয়েছে।’ মোস্তফা আলী কথায় কথায় বোঝালেন, এসবে তাঁর খুব একটা ভরসা নেই। তবে আয়োজন করলে ক্ষতি কী!