এক চুমুক চা

মানুষ চা খেতে শুরু করেছিল পাঁচ হাজার বছর আগে, চীন সাম্রাজ্যে। এরপর ধীরে ধীরে চা ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। বাকিটা ইতিহাস। সময়-অসময়ে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা লাগবেই—এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই চাপ্রেমী মানুষ আছে। তবে দেশ ও সংস্কৃতিভেদে চায়ের স্বাদ হয় ভিন্নতর। একাধিক ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকটি দেশের চায়ের স্বাদ তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।

১৮ শতকের আগে ভারতে চায়ের তেমন চল ছিল না। ব্রিটিশরা ভারতে প্রথম চা উৎপাদনের কাজ শুরু করে। স্বাধীন হওয়ার পর সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। ভারত এখন অন্যতম চা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের মতোই ভারতের প্রায় প্রতিটি রাস্তার কোণেই চায়ের দোকান পাওয়া যাবে। মাসালা চা, দুধ চা সেখানে জনপ্রিয়। জাপানেও একসময় চায়ের প্রচলন ছিল না। সালটা জানা যায়নি, তবে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী যেদিন চীন থেকে মাচা চা-পাতা এনেছিলেন, সেদিন থেকেই জাপানে চা খাওয়ার সংস্কৃতির শুরু। কয়েক শ বছর পর জাপানে চায়ের সংস্কৃতি এখন খুবই শক্তপোক্ত। অনেক ধরনের চা থাকলেও চায়ের আসর জমে ওঠে সবুজ মাচা চায়ের কাপ ঘিরেই। জাপানে চা পরিবেশন করার কায়দাও দেখার মতো। যত্ন নিয়ে, সময় নিয়ে চা বানিয়ে পরিবেশন করা হয়। মাচা চা স্বাদে কিছুটা তেতো হওয়ায় এটি মিষ্টি-জাতীয় খাবারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।

চীন থেকেই আগমন যার, সেখানে চায়ের বৈচিত্র্য থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। চীনে চা এতটাই জনপ্রিয় যে ‘পানির ওপর নাম জীবন’ নয়, সেখানে ‘চায়ের অপর নাম জীবন’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। সেখানে চা বানানোর পদ্ধতিও বেশ ‘নাটকীয়’। বেশ যত্ন নিয়ে এবং সময় নিয়ে চা বানানো হয়। চা বানানোর পদ্ধতি সেখানে ‘চা দাও’ নামে পরিচিত। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গ্রিন টি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও চা বেশ জনপ্রিয়। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও তারা চা পান করেন। ২০০ বছর ভারত রাজত্ব করার সময়ই তারা সেখানে প্রথমবারের মতো চা উৎপাদন শুরু করে। ব্রিটিশরা নিজ দেশে ফেরত আসার সময় এই চা সংস্কৃতি সঙ্গে করে নিয়ে আসে। কফি জনপ্রিয় হলেও, চা-ই এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছে ব্রিটিশদের পানীয়র তালিকায়। বিকেলে এক কাপ চা খাওয়ার রীতিও এ দেশ থেকেই এসেছে। এনা মারিয়া রাসেল, বেডফোর্ডের সপ্তম ডাচেস ১৮৪০ সালে বৈকালিক চায়ের প্রচলন শুরু করেন। দুপুর ও রাতের খাবারের মধ্যে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে খিদে পেত এনার। পরে তিনি গৃহ-সহকারীদের অনুরোধ করেন বিকেল চারটার দিকে হালকা নাশতার সঙ্গে যেন চা পরিবেশন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনে উচ্চবিত্তদের মধ্যে বৈকালিক চা খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। দুধ ও চিনি মিশিয়ে কালো চা, গ্রিন টি, হারবাল টি, আর্ল গ্রে প্রভৃতি চা ব্রিটেনে জনপ্রিয়।

মরক্কোবাসী ১৮ শতকে চায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়। প্রায় প্রতিবার খাওয়ার পরেই এ দেশে চা পান করার রেওয়াজ। যেখানেই যাবেন হাতে এক কাপ মরক্কোর পুদিনা চা ধরিয়ে দেওয়া হবে। গ্রিন টির সঙ্গে পুদিনাপাতা ও বেশি চিনি দিয়ে এই চা বানানো হয়। অতিথি আপ্যায়নে তা পরিবেশন করা হয় জীবন, ভালোবাসা ও মৃত্যু এই তিনটির প্রতীকী অর্থে। অতিথি হিসেবে তিনবারই তা পান করতে হবে, না হলে সেটাকে অপমান হিসেবেই ধরা হয়।

নান্দনিক মেটালের চায়ের পটে পানি টগবগ করে ফুটছে। তাতে চায়ের পাতি দেওয়ার পর কড়া কালো রং হয়ে গেছে। এবার চায়ের কাপে এক ইঞ্চি উচ্চতার সেই কড়া চা ঢালা হবে। চাইলে কেউ কেউ কিছুটা গরম পানি মিশিয়ে নেবেন। না চাইলে সেভাবেই পান করবেন। রাশিয়ায় এভাবেই চা পান করা হয়। চায়ের সঙ্গে দুধ বা চিনি মেশানো হয় না। গরম পানিতে যেই চা-পাতা দেওয়া হয়, সেটি পরিচিত ‘জাভারকা’ নামে। যে পাত্রে চা বানানো হয়, তা ‘সামোভার’ নামে পরিচিত। রাশিয়ায় যেসব পরিবারে সামোভারে চা বানানো হয়, সেসব পরিবারকে সম্মানিত হিসেবেই ধরা হয়। বনেদি পরিবারগুলোতে রুপার তৈরি সামোভারও পাওয়া যায়। রাশিয়ায় সিভিল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সৈন্য ও কারখানার কর্মচারীদের মধ্যে বিনা মূল্যে চা বিতরণ করা শুরু হয়। তখন চা-কে উচ্চবিত্তদের পানীয় বলেই মনে করা হতো। অতিথি আপ্যায়নে চায়ের সঙ্গে ‘টা’ পরিবেশন না করলে সেটা রূঢ় ব্যবহার হিসেবেই ধরা হয়। দুধ চা পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় চা। এরপরই আসবে পেশওয়ারি চা। পানির বদলে দুধের মধ্যে চা-পাতি দিয়ে এটি ফোটানো হয় চুলায়। মসলা চাও পাকিস্তানে জনপ্রিয়। তবে গোলাপি রঙের বিশেষ চায়ের নাম নুন চা, কাশ্মীরি সংস্কৃতি থেকে যার আগমন। পেস্তা বাদাম, আমন্ড বাদাম, লবণ, দুধ, দারুচিনি, লবঙ্গ, তারকা মৌরি দিয়ে এই চা বানানো হয়। বিশেষ কোনো উপলক্ষে মিষ্টি-জাতীয় পদের সঙ্গে এটি পরিবেশন করা হয়।

চায়ের প্রতি নেশা নেই—এমন দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে। ইতালি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কফির ওপরই টিকে থাকে তারা। তবে চা যে একদমই খাওয়া হয় না, তা নয়। চা উচ্চারিত হয় ‘দি’ নামে। খুঁজতে গেলে চায়ের ভক্তও হয়তো বের হয়ে আসবে আনাচকানাচ থেকে। তবে ইতালিতে মূলত ঠান্ডা-জ্বরের সময় চায়ের কদর বেড়ে যায়। তখন গরম চায়ের সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেতে পছন্দ করেন অনেকেই। সাধারণত রং চা ও হারবাল চা পান করেন ইতালিয়ানরা। মজার বিষয় হলো, এই দেশের নাগরিকেরা অন্য দেশে গিয়ে আবার চা খেতে পছন্দ করেন।

তিব্বতের ঠান্ডা হাওয়ায় দুধ চা বা লেবু চা নয়, বরং মাখন চা জনপ্রিয়। তাও আবার নোনতা মাখন। পো চা নামে পরিচিত এই চা ঠান্ডায় তাদের গরম থাকতে সহায়তা করে। চা খাওয়ার কোনো প্রতিযোগিতায় নামলে বাংলাদেশিরাও কিন্তু কম যায় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোনো কারণ ছাড়াই চায়ের কাপে আড্ডা চলতে থাকে।

সূত্র: হান্ড্রেড অ্যান্ড ওয়ান টি ফ্যাক্টস, মেন্টাল‍‍‍ ফ্লস, মাচা টি, ওয়ার্ল্ড টি নিউস, তুসকান ট্রাভেলার, লিভিং ল্যাঙ্গুয়েজ