এক লহমায় বিটিভির ইতিহাস

বিটিভি ভবনের এই ঘরটিই এখন টেলিভিশন জাদুঘর। ছবি: খালেদ সরকার
বিটিভি ভবনের এই ঘরটিই এখন টেলিভিশন জাদুঘর। ছবি: খালেদ সরকার

ঘরটি তেমন বড় নয়। সেই ঘরে থরে-বিথরে সাজানো অজস্র ছবি—সাদাকালো একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে অভিনেতা গোলাম মুস্তফাকে। যাত্রার সাজপোশাকে যাত্রামঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, পাশে ক্রন্দনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ফেরদৌসী মজুমদার। ফেরদৌসী মজুমদার তবে যাত্রাপালায়ও অভিনয় করেছেন! আবার অন্য এক ছবিতে দেখা গেল ফেরদৌসীর সামনে বিশেষ ভঙ্গিতে বসে আছেন তরুণ বয়সের রামেন্দু মজুমদার। দুজনের বসার নাটকীয় ঢংই বলে দিচ্ছে কোনো নাটকের দৃশ্য এটি। আর এসব ছবি দেখতে দেখতে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে পাখা মেলেছে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস।
বিটিভির ‘টেলিভিশন জাদুঘর’-এর ছোট্ট কক্ষটি ছবিতে ছবিতে সাজানো। সাদাকালো আর রঙিন ছবির সমাহারে এখানে যেন স্থির হয়ে আছে সময়।
গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ঢাকার রামপুরার বিটিভি ভবনে টেলিভিশন জাদুঘরে ঢুকে আমরা যখন একের পর এক ছবির মুখোমুখি, মনে হলো, বোধ হয় ফ্রেমের পর ফ্রেম-ছবি দিয়েই তৈরি হয়েছে এই জাদুঘর। ভুল ভাঙল খানিক বাদে, যখন দেখা গেল পুরোনো দিনের ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতিও আছে কিছু। তবে এই ছবি আর যন্ত্রাংশ দেখার পরেও কেন যেন অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে কোথাও।
সেই মাসটিও ছিল ডিসেম্বর—১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিকেলবেলা ঢাকায় তৎকালীন ডিআইটি ভবনে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাদাকালো সম্প্রচার। ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ/ সে শুধু তোমার প্রেমে’—ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া গানটি দিয়েই তো অনুষ্ঠানমালার প্রচার শুরু। এরপর কত শত অনুষ্ঠান, সাদাকালো থেকে রঙিন জগতে প্রবেশ। এই বিস্তর সময়ের যে বর্ণিল খেরোখাতা, তার ইতিহাস কি মাত্র একটি ঘরের পঞ্চাশ-ষাটটি ছবি আর কিছু যন্ত্রপাতির মধ্যে পুরে ফেলা সম্ভব?
পাঠক, উত্তরটি আপনাকে যথা সময়ে জানাব। এর আগে জানিয়ে রাখি একটি তথ্য—বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্যোগে ‘টেলিভিশন জাদুঘর’-এর উদ্বোধন হয়েছে ১ ডিসেম্বর। এখন এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। আপনি চাইলেই জাদুঘরে ঢুঁ দিয়ে দেখে নিতে পারেন বহুব্রীহি নাটকের আফজাল হোসেন ও আসাদুজ্জামান নূরকে; কিংবা যদি দেখতে চান মুস্তাফা মনোয়ার প্রযোজিত সেই বিখ্যাত রক্তকরবীর পাত্রপাত্রীদের, জাদুঘরে আপনার সামনে ফ্রেমবন্দী হয়ে আছেন সাদাকালো যুগের আনোয়ার হোসেন, লায়লা হাসান ও সৈয়দ হাসান ইমাম; দেখে নিতে পারেন কলকাতার বিখ্যাত গণসংগীতশিল্পী সলিল চৌধুরী ও তাঁর পরিবারকে—তাঁদের গান করার দৃশ্য; ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানের প্রবাদপ্রতিম উপস্থাপক ফজলে লোহানী—তিনিও আছেন; ওই যে মন-হরণ করা অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের অপলক চাহনির ছবি, তার মানে কোনো একসময় অড্রে হেপবার্নও এসেছিলেন বিটিভিতে? উত্তর হলো হ্যাঁ। এখানে আরও পাওয়া গেল নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামকে—বিটিভিতে এসে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, সেই দৃশ্য।

১৯৮০ সালের একটি ক্যামেরা
১৯৮০ সালের একটি ক্যামেরা

আর জাদুঘরের এক স্থানে দেখা গেল ফ্রেমবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ১৮ মে রামপুরা টিভি ভবন দেখতে এসেছিলেন তিনি, ছবিটি সেই সময়কার। এভাবে কত মুখ, কত চরিত্র—বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যাঁরা করেছেন, যেসব বিশিষ্টজন এসেছেন এখানে—সবাই ছবি হয়ে আছেন জাদুঘরে।
আছে নানা সময়ে বিটিভির সম্প্রচারকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রও—ভিএইচ টিভি ট্রান্সমিটার, ক্যানন স্কুপি ১৬ এমএস মডেলের ১৬ এমএম নিউজ ফিল্ম ক্যামেরা, রোলেক্স এইচ ১৬ রিফ্লেক্স মডেলের ১৬ এমএম ফিল্ম ক্যামেরা, সি পি-১৬ মডেলের সিনেমা প্রোডাক্টস সাউন্ড ক্যামেরা—সত্তর দশকের সাদাকালো যুগে ব্যবহৃত এই যন্ত্রাংশের পাশাপাশি দেখা মিলল আশির দশকের রঙিন যুগের যন্ত্রপাতি। যেমন কে সি-৫০ মডেলের রঙিন ক্যামেরা, ভিডিও টেপ রেকর্ডার, অডিও ডিস্ক প্লেয়ার, পোর্টেবল মনিটর প্রভৃতি।
এসব যন্ত্র দেখতে দেখতে নিমেষেই এই গণমাধ্যমের বিবর্তনের ইতিহাসও কি ভেসে উঠছে না আমাদের সামনে?
সময়ের বাঁকবদল দেখতে দেখতে চোখ রাখি ইতিহাসের দিকে। এখানে যেন-বা দুয়ার খুলে দিয়েছে ইতিহাস। একটি কাচের বাক্সে দেখতে পাই হাতে লেখা সংবাদের পাণ্ডুলিপি,‘রাজধানীতে বুলগেরিয় চলচ্চিত্র উত্সব শুরু হয়েছে’—এই খবরে চোখ রাখতে না রাখতেই আমাদের ডাক দেন নাট্যকার মমতাজউদ্দীন আহমদ, সেলিম আল দীন ও হুমায়ূন আহমেদ। তাঁদের হাতে লেখা নাটকের পাণ্ডুলিপিগুলো নিশ্চিতই আজ ইতিহাসের স্মারক।
তবে লেখার শুরুতে যে বলেছিলাম, অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে কোথাও, একটি ঘরের পঞ্চাশ-ষাটটি ছবি আর কিছু যন্ত্রপাতির মধ্য দিয়ে কি বিটিভির বিবর্তনের পুরো ইতিহাসকে পুরে ফেলা সম্ভব?
উত্তরটি দিলেন বিটিভির মহাপরিচালক হারুন-অর-রশীদ, ‘জাদুঘরটি কেবল শুরু করেছি আমরা। একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে মাত্র। এখন নিয়মিত পরিচর্যা ও নতুন নতুন জিনিসপত্র সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে একে সমৃদ্ধ করার পালা। যে ছবিগুলো এখানে আছে, অচিরেই সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ লেখা হবে। যন্ত্রাংশগুলো কী কাজে ব্যবহৃত হতো, প্রতিটি যন্ত্রের পাশে লেখা থাকবে তার বিবরণও। আর ভবিষ্যতে এই জাদুঘরে আমরা একটি “ডিজিটাল আর্কাইভ সিস্টেম” গড়ে তুলতে চাই, এর মাধ্যমে বিটিভির আলোচিত অনুষ্ঠানগুলো দেখাতে চাই জাদুঘরের দর্শনার্থীদের।’

বিটিভির অনুষ্ঠানে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, মাদার তেরেসার সাক্ষাৎ​কার নিচ্ছেন ফজলে লোহানী, খান আতাউর রহমান ও খন্দকার নূরুল আলম, মুস্তাফা মনোয়ার যখন প্রযোজক
বিটিভির অনুষ্ঠানে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, মাদার তেরেসার সাক্ষাৎ​কার নিচ্ছেন ফজলে লোহানী, খান আতাউর রহমান ও খন্দকার নূরুল আলম, মুস্তাফা মনোয়ার যখন প্রযোজক

টেলিভিশন জাদুঘরের সময়সূচি
শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা এবং বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট। এ সময়ের মধ্যে যে কেউ রামপুরার বিটিভি ভবনে এসে ‘দর্শনার্থী পাস’ সংগ্রহ করে দেখতে পারেন টেলিভিশন জাদুঘর। এ ছাড়া কয়েকজন মিলে দলবদ্ধভাবে এলে থাকছে গাইড দিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা।