
ঈদের পরদিন। ১৯ জুলাই বেলা তিনটা। কক্সবাজারের পেঁচার দ্বীপ সৈকতে লোনা জলে গা ভাসাতে নামেন নাট্যকার ফারুক হোসেন। এর পরের খবরটা নিশ্চয় সবার জানা। তিনি নিখোঁজ।
২৫ জুলাই বেলা দুইটা। সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে হারিয়ে যান নেত্রকোনার কলেজছাত্রী সিমা আক্তার। এ নিয়ে উপস্থিত পর্যটকদের মধ্যে শুরু হয় হইচই। এগিয়ে আসেন ডুবুরিরা। তাঁরা সাগরে ঝাঁপ দিয়ে ১০ মিনিটের মাথায় মুমূর্ষু অবস্থায় তুলে আনেন সিমাকে। ভর্তি করা হয় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। তারপর চিকিৎসকেরা পেট থেকে লোনা জল বের করে তাঁকে প্রাণে বাঁচান।
একই দিন সকালে লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে বিপদে পড়েন কুমিল্লার আরেক কলেজছাত্রী সাবিনা ইয়াছমিন। স্থানীয় ডুবুরিরা তাঁকেও মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে প্রাণে রক্ষা করেন।
সমুদ্রে গোসলে নেমে নিখোঁজ পর্যটকদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত কক্সবাজারের ইয়াছির লাইফ গার্ড স্টেশনের পরিচালক মোস্তফা কামাল জানান, ১৭ থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত সৈকতে গোসলে নেমে মারা গেছে রাখাইন সম্প্রদায়ের চারজন। নিখোঁজ রয়েছেন নাট্যকার ফারুক হোসেনসহ দুজন। সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে প্রাণে বেঁচেছে আরও অন্তত ২৭ জন পর্যটক। এই যখন পরিসংখ্যান, তখন বর্ষার সময়টায় সমুদ্রসৈকতে সাবধান থাকতেই হবে। জোয়ার-ভাটার হিসাব না করে গোসলে নেমেই বিপদে পড়ছে পর্যটকেরা। আনন্দের ভ্রমণে পড়ছে শোকের ছায়া।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, এই সৈকতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বিচরণ (ব্যবহার) চলে প্রায় ১৫ কিলোমিটারে। লাবণী, সুগন্ধা, শৈবাল পয়েন্টের পাঁচ কিলোমিটার, হিমছড়ির দুই কিলোমিটার, ইনানীর দুই কিলোমিটার, টেকনাফের তিন কিলোমিটার ছাড়া বাকিটা সৈকত থাকে অরক্ষিত। আর সেন্ট মার্টিনের তিন কিলোমিটার সৈকত ব্যবহার করা যায়। অরক্ষিত সৈকতে গোসলে নেমে পর্যটকেরা বিপদে পড়লে সাহায্য করার কেউ থাকে না। তাই এ ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা দরকার। হোটেলে ওঠার পর পর্যটকদের এসব ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। কিন্তু কার কথা কে শোনে?
২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল (বাংলা নববর্ষের দিন) সেন্ট মার্টিনে গোসলে নেমে মারা যান ঢাকার ছয় ছাত্র মানফেজুল ইসলাম, সাদ্দাম হোসেন, ইশতিয়াক বিন মাহমুদ, শাহরিয়ার ইসলাম, সাব্বির হাসান এবং এস এম গোলাম রহিম। এরপর দেশব্যাপী তোলপাড়, চলে কত হইচই। বলছিলেন টুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি এস এম কিবরিয়া খান। তিনি আরও বলেন, এরপর সবই তো স্বাভাবিক। এখনো অরক্ষিত সৈকতে কোনো ডুবুরি নেই, নিরাপত্তার জন্য নেই পুলিশ। বহু ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে সাইনবোর্ড বা লাল নিশানাও নেই।
সাবধান! সৈকতে মৃত্যুফাঁদ
নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডুবুরি মোস্তফা কামাল জানান, লাবণী পয়েন্টে সামনের সৈকতে এখন উত্তর-দক্ষিণে ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার লম্বা একটি গুপ্ত খালের সৃষ্টি হয়েছে। এই গুপ্ত খালে আটকা পড়ে ১৭ জুলাই রাখাইন তিন কিশোরের মৃত্যু হয়। খালের পাশে সৈকতে না নামার জন্য পর্যটকদের সতর্ক করতে উপকূলে একাধিক লাল পতাকা ওড়ানো হচ্ছে। কিন্তু পর্যটকেরা এই নিষেধাজ্ঞা অনেক সময়ই মানছে না।
শুধুই কি লাবণী পয়েন্ট? সি-গাল, সুগন্ধা, কলাতলী পয়েন্ট, ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর সৈকতেও একাধিক গুপ্ত বা ডুবো খালের সৃষ্টি হয়েছে। এক-একটি খাল যেন মৃত্যুফাঁদ। গত ১৪ বছরে এসব ফাঁদে আটকা পড়ে মারা গেছে ৯১ জন পর্যটক। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মারা গেছে ১৮ জন। নিহতদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী।
কক্সবাজারে বেড়াতে আসা ঢাকার ফকিরাপুলের জিন্নাত আলী (৩৭) বলেন, ‘সমুদ্রে গোসল করার জন্যই তো আমরা এখানে আসি। পর্যটকদের ঘিরে এখানে সপ্তাহে শতকোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। অথচ সৈকতে পর্যটকদের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থাটুকু কেউ করে দিচ্ছে না। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল তৈরি করে কী লাভ, যদি পর্যটকদের সমুদ্রে নামার ঝুঁকি থাকে?’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, লাবণী পয়েন্টের নির্দিষ্ট জায়গা রশি দিয়ে ঘিরে নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে লাবণী পয়েন্টকে ‘সুইমিং জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সাগর এখন প্রচণ্ড উত্তাল। তিনি বলেন, আবহাওয়ার কারণে লাবণী পয়েন্টের সুইমিং জোন ছাড়া সৈকতের অন্য কোথাও গোসলে নামা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পর্যটকদের সতর্ক করতে সৈকতজুড়ে চলছে নানা প্রচারণা। তারপরও অনেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে বিপদে পড়ছে।
পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার মো. জহিরুল ইসলাম জানান, ঈদের পর থেকে সৈকত ভ্রমণে আসে অন্তত ছায় লাখ পর্যটক। এত বিপুলসংখ্যক পর্যটকের নিরাপত্তা দিতে দেড় শতাধিক টুরিস্ট পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন লাবণী পয়েন্ট, দরিয়ানগর, ইনানী ও হিমছড়ি সৈকতে টুরিস্ট পুলিশ পাহারা দিলেও অন্য সৈকতে তা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে নির্জন সৈকতে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
সতর্কতা
* সৈকতে নামার আগে নিশ্চিত হোন সাগরে জোয়ার, নাকি ভাটা। জোয়ার হলে বালুচরে সবুজ পতাকা উড়তে থাকে। ভাটা হলে লাল পতাকা। ভাটার সময় সাগরে নামা বিপজ্জনক।
* বিপজ্জনক খাদ বা গুপ্ত খাল নির্দেশনার জন্য থাকে লাল পতাকা।
* সাঁতার জানা না থাকলে লাইফ জ্যাকেট বা টিউব নিয়ে কোমরসমান পানি পর্যন্ত নামা যায়।
* শিশুদের কোনো অবস্থাতেই সমুদ্রের পানিতে নামতে দেবেন না।
* নারীদের শাড়ি পড়ে সমুদ্রে নামা বিপজ্জনক।
* সমুদ্রে নেমে কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপ দেবেন না। দ্রুত আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাইফ গার্ডের সাহায্য নিন।
* মাতাল অবস্থায় সাগরে নামা খুবই বিপজ্জনক।
* হৃদ্রোগীদের জন্য উত্তাল ঢেউ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
* সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারদিকে প্রবাল পাথরের স্তূপ। জোয়ার বা ভাটার টানে যে-কেউ পাথরের কুণ্ডলীতে আটকা পড়তে পারে। পাথরে আটকা পড়লে উদ্ধার তৎপরতাও চালানো যায় না। কক্সবাজারের ইনানী সৈকতেও আছে পাথরের স্তূপ। এখানেও সাবধান।
* সমুদ্রে নামার আগে হোটেল রেজিস্টারে সঠিক নাম ঠিকানা ও যোগাযোগের মাধ্যম লিপিবদ্ধ করুন। কোথায় যাচ্ছেন, তা হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখুন।
* সঙ্গে পেশাদার গাইড রাখা ভালো। দূরে কোথাও গেলে পুলিশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।