এটাই তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা

বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব নিতে হবে বাবাকেও। মডেল: সুমন, ইয়াফি ও তাসরিবা। ছবি: সুমন ইউসুফ
বাচ্চার দেখভালের দায়িত্ব নিতে হবে বাবাকেও। মডেল: সুমন, ইয়াফি ও তাসরিবা। ছবি: সুমন ইউসুফ

কয়েক দিন আগে ফেসবুকে হঠাৎ একটি লেখায় চোখ আটকে গেল। লেখাটা এমন ছিল, ‘বাচ্চা হওয়ার পর আমার স্বামী সব বিষয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। বাচ্চার ডায়াপার বদলানো, খাওয়ানো, মাসে দুই-তিন রাত জাগা ইত্যাদি। এটা নিয়ে আশপাশের মানুষেরা আমাকে বলেন, কত ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি আমি। আমার স্বামী দুই-তিন রাত জাগে, বাকি মাস তো আমাকে দেখতে হয়। বাচ্চাটা তো আমাদের দুজনের। আর ও বাচ্চার দেখাশোনা করবে—এটাই তো স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক বিষয়টিকে সবাই অস্বাভাবিক মনে করে কেন?’ এই বাড়তি প্রশংসা কি আসলেই প্রাপ্য স্বামীর? মন খারাপের কোনো এক মুহূর্তে হয়তো তিনি লেখাটি লিখেছেন।
লেখাটি মনে ভাবনার খোরাক দিল। আসলেই তো? বিশ্বায়নের এ যুগে সব সময় নারী-পুরুষ সমতার কথা বলা হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে কাজ করবেন। ঘরে-বাইরে একে অপরকে সহযোগিতা করবেন। একধরনের সমঝোতার মাধ্যমে দাম্পত্য জীবন কাটবে। সমাজের নিয়মের কারণে পুরোপুরি সেই পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না। যে স্বামীরা কিছুটা কাজ করেন, সমাজ তাঁদের বাহবা দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন মনে করেন, এর জন্য সবার আগে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। মেয়েরা এখনো এ ধরনের কথা শোনেন তার মানে সমাজ বদলাচ্ছে না। লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে, প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে স্বামী সব কাজে সমানভাবে অংশ নেবেন, সেটাকেই স্বাভাবিক রূপ দিতে হবে।

খাবার টেবিলের এই দৃশ্যটি স্বাভাবিক মনে করতে হবে
খাবার টেবিলের এই দৃশ্যটি স্বাভাবিক মনে করতে হবে

বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখা যায়, কোনো কোনো স্বামী এক দিন কিছু রান্না করে স্ত্রীকে চমকে দেন। তখন সেই স্বামী ‘ভালো স্বামী’ হয়ে যান সবার কাছে। এটা তিনি বিশেষ কিছু করছেন সেই ভাবনাই ভুল। সংসার তাঁরও। তাঁর কাজ কেন আলাদা করে মর্যাদা পাবে, স্ত্রী যে দিনের পর দিন এই কাজ করে আসছেন, তাঁর তো বিশেষ কোনো স্বীকৃতি মেলেনি।
অনেক পুরুষ বা তাঁর পরিবার ভাবে, বউ থাকতে তাদের ছেলেটি কেন কাজ করবেন? এই ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ছোটবেলা থেকে বাড়ির মেয়েটিকে সব কাজ করার কথা না বলে ছেলেটিকেও বলতে পারেন। বোন এক দিন ঘর গোছালে, ভাই এক দিন গোছাবে। তেমনি বিয়ের পর সংসারের সব দায়িত্ব শুধু স্ত্রীর—সেই ভাবনা ভুল। যতটুকু স্ত্রী করবেন, ততটুকু স্বামীকেও করতে হবে।
সন্তান হওয়ার পর স্ত্রীর প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে হবে। তাঁর ঘুমানো, খাওয়া—সব দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নবজাতকের প্রতি যতটা যত্ন নেওয়া হয়, অনেক সময় মায়ের দিকে সেভাবে নজর দেওয়া হয় না। কখনো কি ভেবেছেন, স্ত্রী রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছেন। তাঁর মনের খবর নিয়েছেন। আর দুই-তিন দিন রাত জেগেই বাহবা নিতে চান। ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ভাবখানা এমন, উফ্, কত সাহায্য করলাম তোমাকে। এটাকেই স্বাভাবিক মনে করেন অনেকে। ‘সৌভাগ্যবান বউ’ হিসেবে খেতাবও জুটে যায় স্ত্রীর। কেউ বোঝার চেষ্টাও করেন না, এটা স্বাভাবিক চিত্র নয়। অস্বাভাবিক চিত্রকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি।
বেসরকারি একটি ব্যাংকে কাজ করেন ফাহমি আহমেদ (ছদ্মনাম)। বিয়ের আগে বাড়িতে মা সব করে দিতেন। বিয়ের পর সেই অভ্যাস থেকে গিয়েছিল। নিজে কখনো গ্লাসে পানি ঢেলে খাননি। বিয়ের পর বউয়ের কষ্ট দেখে এটা-সেটা এগিয়ে দিতেন। ধীরে ধীরে উপলব্ধি হলো, আসলে বউ সব কাজ করবেন, তিনি পা গুটিয়ে বসে থাকবেন, সেটা খারাপ দেখায়। ‘বিশ্বাস করেন, ছয় মাস পর এই উপলব্ধি হলো। আমার এক বন্ধুর ভূমিকা ছিল। তাঁকে দেখতাম বউকে সব কাজে সাহায্য করছে। সেই বন্ধুকে অন্য বন্ধুরা খ্যাপাত। বলত, “তোর জন্য সংসারে অশান্তি হবে। মেয়েদের মতো কাজ করিস কেন? তোর বউ খুবই কপাল নিয়ে জন্মেছে।” উত্তরে ও বলত, “সংসার দুজনের, বাচ্চাও দুজনের। সবকিছুতে সমান অধিকার থাকলে কাজটাও সমান করা উচিত।” মনে ধরল কথাটা। ভেবে দেখলাম ও তো ঠিক কথাই বলছে। ছয় মাস বউ নিজে সব করেছে, এটা ভেবে বরং লজ্জাই লাগল। তবে আমাকেও শুনতে হয়, কপাল ভালো তোর বউয়ের। স্বামী কাজ করে সঙ্গে। বউকেও এটা সেটা শুনতে হয়। ও মাঝে মাঝে মন খারাপ করে। এসব কথাকে পাত্তা না দিতে বলি। যাঁরা বলেন, তাঁরা নিশ্চয় একদিন নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন।’ বলেন ফাহমি।
ফ্যামিলি ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন স্মার্ট পুরুষ তিনিই, যিনি ঘরে-বাইরে সব কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেন। স্ত্রীর কাজ মনে না করে বাড়ির কাজ মনে করলে দেখবেন মনের সংকীর্ণতা কেটে গেছে।
সমাজ বদলাচ্ছে, বিশ্বায়নের ছোঁয়া এসে লাগছে, এসব বলে আমরা কত বড় বড় কথা বলছি। স্বামী হিসেবে সভা-সেমিনারে এসব না বলে আগে নিজের বাড়িতে সেই পরিবর্তন আনুন। পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে; যা স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, তা স্বাভাবিকভাবে করুন।