এটাই তো আমাদের সহজাত সম্প্রীতি

লক্ষ্মীপুরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক হারান চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন তাঁর বন্ধু নিজাম উদ্দিন ফারুকীকে হারানোর কথা

মানুষ তার জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত আর দুঃসময়ের স্মৃতি কখনো হয়তো ভোলে না। তাই তো আমার শোকের সময়ের একটি স্মৃতি বারবার মনে পড়ে। সেটা প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। এক রাতে আমার বাবা মারা গেলেন। আমি দিগ্ভ্রান্ত, শোকে আচ্ছন্ন। কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। খবর পেয়ে বাসায় ছুটে এলেন নিজাম উদ্দিন ফারুকী। আমার আত্মীয়স্বজনের কাছে মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেওয়া দরকার। এ জন্য প্রথমে আমার বড় বোনের বাসায় পৌঁছানো জরুরি। বোনের বাড়ি প্রায় ১২ মাইল দূরে। তখন মুঠোফোন নেই। যোগাযোগব্যবস্থাও উন্নত নয়। নিজাম উদ্দিন ফারুকী বেরিয়ে গেলেন সংবাদ দিতে। গভীর রাতে পায়ে হেঁটে তিনি এত দূর গিয়েছেন, বোনকে সঙ্গে নিয়ে আবার ভোরে ফিরে এসেছেন। আমি এই কথা কোনো দিন ভুলব না।

হারান চন্দ্র মজুমদার

সেই নিজাম ভাই নিজে গত মাসে বিদায় নিলেন। আমি গিয়েছিলাম তাঁর বিদায় মুহূর্তে। জানাজার সময় এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার ছবি সেদিন কেউ তুলেছিল। ফেসবুকে অনেকে ছবিটি দেখে ধর্মীয় সম্প্রীতির নানা কথা লিখেছেন। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি বিশেষ কিছু মনে হয়নি। এটাই তো হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে, এটাই তো স্বাভাবিক, এমনই তো আমরা।

লক্ষ্মীপুর সদরের একই গ্রামের মানুষ আমরা। কয়েক বাড়ি পরই নিজাম উদ্দিন ফারুকীদের বাড়ি। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা আমাদের। ভলিবল খেলতাম একসঙ্গে। তাঁকে আমি ডাকতাম নিজাম ভাই। যদিও তিনি বয়সে ছিলেন আমার কয়েক বছরের ছোট। তবু বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, আমরা পরস্পরকে সম্বোধন করতাম ‘আপনি’ বা ‘স্যার’ বলে। কারণ, দুজনেই স্কুলে শিক্ষকতা করতাম।

নিজাম ভাই তখন কলেজে পড়েন। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বাবা এসব পছন্দ করতেন না। এক রাতে এসে বললেন, ‘আপনাদের বাসায় খাব।’ তিনি বসলেন। আমার মা নিজ হাতে তাঁর পাতে ভাত তুলে দিলেন। মানুষের জীবনে বহু রকম গল্প থাকে। নিজাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার এমন হাজারো গল্প।

বহু বছর আগে গ্রামে কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছিল। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছিল। মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হতো না। আমি তখন গ্রাম্য চিকিৎসাসেবা দিতাম। নিজাম ভাই সার্বক্ষণিক আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন। সেই সময়েই আমাদের বন্ধুত্বের ভিত অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে নিজাম উদ্দিন ফারুকী একটা সমবায় সমিতি পরিচালনা করেছেন। অগ্রণী গন্ধব্যপুর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের মাধ্যমে এলাকার কৃষকদের অনাবাদি জমি চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন সমিতির সভাপতি ছিলেন নিজাম ভাই, আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। সমিতি পরিচালনার সময় অনেক জেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়। নিজাম ভাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে সারা বাংলাদেশ ঘুরেছেন। কত অভিজ্ঞতা, কত মজার মজার স্মৃতি। আমার বন্ধু সারা জীবন মানুষের উপকার করে গেছেন। তাঁর কাছে অনেক কিছু শেখার ছিল। আমার এই পরোপকারী বন্ধুর কথা আজীবন মনে থাকবে।

২০০৯ সালে আমি চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছি। এর আগে পর্যন্ত গন্ধব্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। ধর্ম নিয়ে আমাদের কখনো কোনো বাড়াবাড়ি হয়নি। এখনো গ্রামে সবাই মিলেমিশে থাকি। কাউকে মনে হয় না সে আলাদা। এটাই তো সহজাত সম্প্রীতি। তবে আজকাল দেশের বিভিন্ন স্থানের ঘটনায় হতাশ হই। খারাপ লাগে। মনে প্রশ্ন জাগে, এমন কেন হচ্ছে!

অনুলিখিত