
বসার ঘরের পুরোনো বেতের সোফাটা মোটেও পছন্দ নয় রিপার (ছদ্মনাম)। জরাজীর্ণ অবস্থা ওটার, আর ডিজাইনটাও সেকেলে। স্বামীকে বলে একদিন বিশেষ ছাড়ে একটা নতুন স্মার্ট ডিজাইনের সোফা কিনে নিয়ে এল রিপা। বাড়িতে যখন প্যাকেট খুলে নতুন সোফা বসানো হচ্ছে, সবাই খুশি, তখন শাশুড়ির মুখ ভারী। একবার কেবল নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বেতের সোফাটা তোমার শ্বশুর আজ থেকে ৩০ বছর আগে সিলেট থেকে আনিয়েছিলেন, তাঁর খুব পছন্দ ছিল ওটা। ওনার একটা স্মৃতি। এটা সরিয়ে দিলে?’
শাশুড়ির ভাগনি তাঁর জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন একটা রঙিন টেবিল ল্যাম্প, খুশি হয়ে তিনি সাজিয়ে রেখেছেন ওটা ড্রয়িংরুমে। অফিস থেকে ফিরে দেখে বউমার চোখ কপালে, ‘এটা এখানে কে রেখেছে? খুব খ্যাত লাগছে। মানাচ্ছে না মোটেও।’ শাশুড়ি মিন মিন করে বলার চেষ্টা করলেন, ‘আমার বোনের মেয়ে দিয়েছে এটা।’ বউমা আরও বিরক্ত, ‘দিলেই সাজিয়ে রাখতে হবে? পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে না?’
একই ঘরে, যেখানে কেউ সাবেক গৃহকর্ত্রী, আর আরেকজন নতুন কর্তৃত্ব পাচ্ছেন—এমন টুকটাক প্রায়ই লেগে যেতে পারে। গৃহসজ্জার নানা সামান্য বিষয় নিয়েও। কেউ হয়তো দেয়ালে ছবি টাঙানো পছন্দ করেন না, কেউ আবার দেয়ালজুড়ে লাগিয়ে রাখেন প্রিয়জনের ছবি। কেউ পর্দার উজ্জ্বল রং পছন্দ করেন, কারও আবার ক্যাটক্যাটে রং পছন্দ নয়, তার চাই সাদা বা ক্রিম। মানুষে মানুষে পছন্দের ভিন্নতা থাকতেই পারে, এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু সেটা যেন মনোমালিন্যের কারণ না হয়ে ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখা চাই।
অনেক সময় প্রকাশভঙ্গির কারণে এমন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তুলকালাম ঘটে যেতে পারে। যেমন মুখের ওপর ‘এটা ভীষণ খ্যাত’ বা ‘জিনিসটা তো বিশ্রী’ এমন মন্তব্য না করে একটু সহনীয় মন্তব্য করা উচিত। যেমন জিনিসটা ভালোই, কিন্তু এ ঘরে কেমন যেন মানাচ্ছে না। কোনো পুরোনো জিনিস বাতিল করে দেওয়ার আগে একটু আলোচনা করে নেওয়াই ভালো। যেমন ‘সোফাটা এত পুরোনো হয়ে গেছে যে আর ঠিক করতেও অনেক টাকা যাবে। তার চেয়ে নতুন একটা কিনে ফেলা যাক, কী বলেন আম্মা?’ অনেক সময় পুরোনো জিনিসের সঙ্গে অনেক স্মৃতি, অনেক সেন্টিমেন্ট ও অনেক আবেগ জড়িয়ে থাকে। এই আবেগের মূল্য দিতে হবে বৈকি।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মাহমুদা বেগম থাকেন ঢাকার লালমাটিয়ায় ছেলের বউয়ের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে বলেন, ‘আজকালকার মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে আমাদের তো নাও মিলতে পারে। আমরা সেকেলে মানুষ, আমাদের পছন্দও সেকেলে। কিন্তু বউমা বিপুল উৎসাহে নিজের মতো করে ঘর সাজাতে চাইলে আমি সাধারণত বাধা দিই না। করুক না। এর একটা ইতিবাচক দিকও আছে। এতে ঘরের প্রতি, সংসারের প্রতি মায়া-মমতা বাড়ে। নিজের হাতে সাজানো সংসারের আকর্ষণই আলাদা। এসব ছোট বিষয়েও নিজের মতামত পাত্তা না পেলে শ্বশুরবাড়িতে চিরকাল পরের বাড়িই মনে হবে। মনে হবে বাবার বাড়িতে একটা মেয়ে যেভাবে নিজের পছন্দ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এখানে বুঝি সেই অধিকার নেই।’
ওদিকে তাঁর পুত্রবধূ জেরিন পেশায় স্থপতি। ইন্টেরিয়র নিয়ে তাঁর বিশেষ উৎসাহ। বিয়ের পর থেকে ছয় সাত বছরে পাল্টে ফেলেছেন এ বাড়ির অনেক কিছুই। পেশাগত কারণে তাঁর বিশ্বাস, সময়ের আধুনিক গৃহসজ্জার ট্রেন্ডটা তাঁর চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝেন না এ বাড়িতে। হেসে বলেন, ‘তারপরও আমার শাশুড়ির কিছু চাওয়াকে আমি শ্রদ্ধাই করি। তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন, আগে বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে থাকত বইগুলো। এখন আমি তাঁর ঘরেই একটি কর্নারে শেলফ করে নিয়েছি। বইগুলো ওখানে সাজানো থাকে। প্রয়াত শ্বশুরের একটা বৃহদাকার ইজি চেয়ারকে কোথাও জায়গা করতে পারিনি, তাই বলে বাতিল করে দিইনি ওটাকে। কেননা, এই ইজি চেয়ারে বসে তিনি বিকেলে চা খেতেন, পরিবারের অনেক স্মৃতি ওটাকে ঘিরে। শেষ পর্যন্ত একটা বারান্দায় কোনোমতে ওটাকে বসানো গেছে। এ জন্য বারান্দার অবয়বেও খানিকটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
একই বাড়িতে শাশুড়ি বউমার পছন্দ-অপছন্দের গরমিলকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করাটাই শ্রেয়। শাশুড়িকে মনে রাখতে হবে, নতুন প্রজন্মের পছন্দে ফারাক তো থাকবেই, আর শ্বশুরবাড়িতে নতুন অধিষ্ঠিত মেয়েটির সামান্য পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব না দিয়ে উড়িয়ে দিলে তাঁর মনটাই যাবে ছোট হয়ে। এ বাড়িকে নিজের করে ভাবতে সমস্যা হবে। আবার বউমারও মনে রাখা উচিত, বহু বছর ধরে চলে আসা সাজসজ্জা এক কথায় বাতিল করে দেওয়াটা ভালো কথা নয়। বিশেষ করে, পুরোনো বা সেকেলে মনে হলেও, শাশুড়ির পছন্দের প্রতি একটা শ্রদ্ধা থাকতেই হবে। যদি পাল্টাতেই হয়, তা ধীরে ধীরে, আলোচনা করে এবং কটু মন্তব্য বা উপহাস করে নয়।