এশিয়ায় প্রথম বাংলাদেশি রোভার

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) দল ইউআইইউ মার্স রোভার টিম সামগ্রিকভাবে ১৩তম ও এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর করে এবারের ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে
ছবি: সংগৃহীত

মহাকাশবিজ্ঞানীদের একটা অংশ মনে করেন, ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহের বুকে গড়ে উঠবে মানববসতি। তবে এই লক্ষ্য অর্জন করতে চাই অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। চাই এমন সব আধুনিক রোভার, যেগুলো মঙ্গলপৃষ্ঠে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ যাচাই করবে। আর এগুলো তৈরির জন্য দিন-রাত কাজ করে চলেছেন নানা দেশের বড় বড় বিজ্ঞানী।

এ রকম রোভার তৈরির চ্যালেঞ্জ নিয়েই একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের দি মার্স সোসাইটি। ‘ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ’ (ইউআরসি) নামের এ প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পান। দুই ধাপের বাছাইপর্ব শেষে ইউআরসি ২০২২-এ পৃথিবীর নানা প্রান্তের ১০টি দেশের ৩৬টি দল ফাইনালের জন্য উত্তীর্ণ হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সুযোগ পায় ৫টি দল। ১ থেকে ৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের হ্যাঙ্কসভিল শহরের মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশনে হয়ে গেল প্রতিযোগিতার ফাইনাল। যেখানে বাংলাদেশের ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) দল ইউআইইউ মার্স রোভার টিম সামগ্রিকভাবে ১৩তম ও এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর করে।

কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিলে গড়েছেন ইউআইইউর দল। দলকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে ইলেকট্রিক্যাল, সফটওয়্যার, কমিউনিকেশনসহ ছয়টি উপদলে ভাগ করা হয়েছিল। কিছু কাজ নিয়ন্ত্রিত, আবার কিছু কাজ রোভার নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে সমাধান করবে। যেমন, মাটি পরীক্ষা করে জীবনের অস্তিত্ব খোঁজা, বিভিন্ন সুইচ অন–অফ করা, স্ক্রু টাইট করা, ড্রয়ার খোলা ও বন্ধ করা, কঠিন পরিস্থিতিতে স্বয়ংক্রিয় চলাচল ইত্যাদি। সব কটি বাধাই সফলভাবে অতিক্রম করেছে ইউআইইউ মার্স রোভার দল।

দলনেতা কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী রকিব হাসান বলেন, ‘এই প্রকল্প নিয়ে আমরা গত বছর থেকে অনেক কাজ করেছি৷ করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। এর মধ্যেও কর্তৃপক্ষ আমাদের বিশেষ ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে কাজ এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। দলের প্রত্যেকের মধ্যেই ভালো করার মনোবল ছিল। সেই মনোবলকে চাঙা করেছেন আমাদের উপদেষ্টা শিক্ষকেরা। দলের প্রতিটি বিভাগই নিজেদের কাজে যথেষ্ট শ্রম দিয়েছে। তবে যেহেতু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগ নেই, তাই আমার দলের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগকে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে যন্ত্রের কাজ শিখতে হয়েছে, যা বেশ কঠিন ছিল। সব মিলিয়ে দলগত কাজ করতে পেরেছি বলেই আমাদের এ সাফল্য।’ রকিব জানান, তাঁদের এই রোভার মঙ্গল গ্রহের জন্য বানানো হলেও পৃথিবীর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন মানুষ যেখানে পৌঁছাতে পারে না, সেখানে এই রোভার পাঠানো সম্ভব। হাসপাতালে রোগীর কাছে সময়মতো ওষুধ পাঠানো বা কোনো যন্ত্র মেরামতেও রোভারকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

উপদেষ্টা হিসেবে দলটিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক আকিব জামান। মজার ব্যাপার হলো, গত বছর মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) যেসব শিক্ষার্থীর দল এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেই দলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আকিব। তখন তিনি ছিলেন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী হিসেবে জয় পাওয়া, নাকি উপদেষ্টা হিসেবে নিজের ছাত্রদের জয় দেখা—কোনটা বেশি আনন্দদায়ক? জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে।

মুঠোফোনে আকিব জামান বলেন, ‘দুটোই সমান আনন্দের। গতবার যখন আমরা জয় পাই, আমি আনন্দে যেভাবে চিৎকার করে উঠেছিলাম, এবারও ঠিক তেমনটিই হয়েছে। দুটোই তো আমার দল৷ তবে এবার একদম নতুন দল গঠন করে এত বড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ সত্যিই অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমি যখন লেকচারার হিসেবে ইউআইইউতে জয়েন করি, তখনো মার্স রোভার টিম গঠিত হয়নি। তাই বলতে পারি, একদম শুরু থেকে দলটির সঙ্গে আছি। নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দিয়ে দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে সিস্টেম ডিজাইন, সব ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। যেহেতু এই দল দিয়েই আমরা মার্সের কোনো প্রতিযোগিতায় যাত্রা শুরু করলাম, তাই উপদেষ্টা হিসেবে একটু বেশি দায়িত্ব নিতে হয়েছে।’ প্রযুক্তিগত দিক ও ব্যবস্থাপনা, দুটো দিকেই আকিবকে খেয়াল রাখতে হয়েছে। এ ছাড়া কঠিন কোনো সিস্টেম দেখলে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়ে যান। তাই সেটাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে শেখাতে চেষ্টা করেছেন তিনি।

ভবিষ্যতে বিশ্বের সেরা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগোতে চান দলের সদস্যরা। তবে এ জন্য কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। প্রভাষক আকিব জামানের মতে, ‘আমাদের দেশের অনেকেই আছেন, যারা রাতারাতি সাফল্য চান। কিন্তু এটা হয় না। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে হয়। আমি সেই ধারা শুরু করতে চাই। এবার ১৩তম হয়েছি, সামনের বার হয়তো আরও ভালো করব। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় বা মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলোর মতো স্বীকৃত দলকে হারিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের নামকে সেরার তালিকায় নিয়ে যাওয়া। ’

ব্যয়বহুল এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সব রকম সহযোগিতার জন্য দলের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. চৌধুরী মোফিজুর রহমানকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান।

ইউআইইউ মার্স রোভার দলের সদস্যরা হলেন প্রভাষক আকিব জামান (প্রকল্প পরিচালক), অধ্যাপক হাসান সরওয়ার (প্রকল্প উপদেষ্টা), রকিব হাসান (দলনেতা), আবিদ হোসেন (যান্ত্রিক ব্যবস্থা উপদল নেতা), আহমেদ জুয়ায়েদ (বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা উপদল নেতা), টি এম আল-আনাম (যোগাযোগ ব্যবস্থা উপদল নেতা), আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (স্বয়ংক্রীয় যাত্রাব্যবস্থা উপদল নেতা), জিদান তালুকদার (জীবন অনুসন্ধানী উপদল নেতা) এবং আফসানা আইরিন (জীবন অনুসন্ধানী উপদল সদস্য)।