এই গ্রীষ্মে আমাদের দেশে গোপালভোগ থেকে শুরু হয়ে হিমসাগর, ক্ষীরশাপাতি, লক্ষ্মণভোগ, আম্রপালি, ল্যাংড়া, হাঁড়িভাঙা আর মধুরেণ সমাপয়েৎ ফজলি নিয়ে আমলীলা চলতেই থাকে ঘরে ঘরে। এহেন শত শত জাতের দেশি আমের রূপরসে মশগুল এই আমরা তেমন করে ভেবে দেখার সুযোগই পাই না দেশ–বিদেশে সমাদৃত হরেক রকমের আমের কথা।

ফজলি
ছবি: উইকিপিডিয়া

তবে আম কিন্তু শুধু আমাদের বাংলাদেশ নয়, বহু দেশেই খুবই জনপ্রিয় ও বিশিষ্ট ফল। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং পাকিস্তান ছাড়াও সেই ফিলিপাইনের জাতীয় ফলও কিন্তু আম। তাই তো এই ভুবনায়নের চলমানতায় ব্রিটিশ ডেজার্ট  ‘ম্যাংগো ফুল’ আর শামদেশের স্টিকি রাইস, কোকোনাট মিল্ক আর ম্যাংগো আমাদের আম-দুধ-ভাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ দেশের আমজনতার কাছে। এমন এক সময়ে তো বিদেশি আমগুলোর ব্যাপারে সবার আগ্রহ তৈরি হওয়ারই কথা।

আমের গোড়ার কথা

আমের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এর ইংরেজি ম্যাংগো নামটি সেই মসলা–বাণিজ্যের হাত ধরে বিলাতে গিয়েছে মালয়ালম ভাষার মান্না বা মাংগা নাম থেকে। আবার এদিকে প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে একে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে আম্র, রসলা, সহকারা ইত্যাদি নামে। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, সেই ২৫-৩০ মিলিয়ন বছর আগে উত্তর-পূর্ব ভারত, আসাম, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এই ভৌগোলিক অবস্থানেই আমের ফলন ও প্রচলন ঘটে, যা ভারতের দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়ে। এই আম বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের হাত ধরে চলে যায় চীন দেশে।

আনওয়ার রাতোলে
ছবি: উইকিপিডিয়া

স্প্যানিশ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও মেক্সিকোতে। মজার ব্যাপার হলো, ভারতে আসা পর্তুগিজরা ভারতীয় আমের সুমিষ্ট স্বাদে মজলেও এর আঁশালো ভাব দূর করতে এর বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনে গ্রাফটিং ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, যারই নিদর্শন হচ্ছে আজকের বিখ্যাত আলফান্সো আমসহ আধুনিক সব আমের জাত। এই পর্তুগিজরাই প্রথম ইউরোপ ও আফ্রিকায় নিয়ে যায় আমের ডালি। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, মোগল সম্রাট বাবর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, কুইন ভিক্টোরিয়া—সবার জীবনেই আমকাহিনি খুঁজে পাওয়া যায়।

দেশ-বিদেশের আম

ভারত
আমের সূতিকাগার এই ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন ধর্মালম্বীর কাছে আমগাছ আর আমপাতার আছে আলাদা কদর। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের খাদ্যসংস্কৃতিতে বহু জনপ্রিয় জাতের আম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ভারতে আছে চোষা, আলফানসো, কেশর, বাদামি, দশেরি তোতাপুরি ইত্যাদি আম। এর মধ্যে রূপ ও স্বাদে সেরা আলফানসো আম বিশ্বজুড়ে খুবই জনপ্রিয়। একে আমের রাজা বা কিং অব ম্যাংগোজও বলা হয়।

চোষা
ছবি: উইকিপিডিয়া

আলফানসো আবার বেশি হয় মহারাষ্ট্রে। আবার মধ্যপ্রদেশে ফলানো আফগানি বংশোদ্ভূত নুরজাহান আম বিশ্বের বৃহত্তম আমের জাত হিসেবে খুব বিখ্যাত। দিল্লি-উত্তর প্রদেশও কম যায় না আমের দিক থেকে।

আলফানসো
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমাদের প্রিয় হিমসাগর আর ল্যাংড়া আমও পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর ফলে। আর আমাদের যেটা গোপালভোগ, সেটাই আবার পশ্চিমবঙ্গে বোম্বাই। আমাদের যেমন রাজশাহী, চাঁপাই, ওপার বাংলায় তেমনি মুর্শিদাবাদ আর মালদহ আমের জন্য বিখ্যাত। সেখানে নবাবপসন্দ, বেগমপসন্দ থেকে শুরু করে রয়েছে হরেক জাত ও স্বাদের আম।

পাকিস্তান
আম উৎপাদনের দিক থেকে খুব অগ্রবর্তী না হলেও সমকালীন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশের যথাযথ শর্ত ও নিয়ম মেনে সেখানে আম রপ্তানিতে পাকিস্তান শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। আমের জুসেও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি পরিচিত নাম। তাদের সিন্ধ অঞ্চলে জন্মানো সিন্ধ্রি আম খুবই উপাদেয়, যাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হানি ম্যাংগো, কুইন অব ম্যাংগো বা আমের রানি বলা হয়। এ ছাড়া আমাদের চিরচেনা ফজলি আম সে দেশে ফাজরি আম বলে সমাদৃত। প্রসঙ্গ জানিয়ে রাখলে মন্দ হয় না, পাকিস্তান আবার আম কূটনীতিতে বেশ এগিয়ে। যদিও এবার ততটা জমছে না।

চীন

কেইট
ছবি: উইকিপিডিয়া

চীনের সঙ্গে আমের সম্পর্কটি বড়ই চমকপ্রদ। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম আম উৎপাদনকারী এই দেশে একসময় আম কেউ খেতই না তেমন আগ্রহ করে। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উপহার দেওয়া আম নিজের বাধ্য মিলিশিয়া বাহিনীকে পুরস্কারস্বরূপ পাঠান দেশটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও সে–তুং। ব্যাস, তারপর থেকেই আম নিয়ে শুরু হয়ে গেল উন্মাদনা, আম হয়ে গেল মাওবাদী প্রতীক। সেই আম খাওয়ার ঘটনাও কম চমকপ্রদ নয়। তবে আজকাল আর ব্যাপারটি মুখ্য নয় সে দেশে, বরং রসাল ও উপাদেয় ফল হিসেবেই চীনে এর কদর বেড়েছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারা বেশ বড় জাতের কেইট আম থেকে শুরু করে একেবারে ছোট্ট কিডনি ম্যাংগোসহ নানা জাতের আম রপ্তানি করে থাকে।

থাইল্যান্ড

নাম ডক মাই
ছবি: উইকিপিডিয়া

থাইল্যান্ডের মিষ্টি থেকে ঝাল, সব ধরনের খাবারে আমের ব্যবহার অত্যন্ত লক্ষণীয়। সে দেশের বিখ্যাত ডেজার্ট স্টিকি রাইস, কোকোনাট মিল্ক আর ম্যাংগো তৈরি করতে নারকেলের দুধে রান্না করা আঠালো চালের ভাতের সঙ্গে ‘ওক রং দামনেয়ন’ নামের এক বিশেষ জাতের অত্যন্ত সুমিষ্ট আম ব্যবহৃত হয়। আবার শ্রিম্প পেস্ট আর খুব ঝাল মরিচ দিয়ে বানানো আমের সালাদও দারুণ জনপ্রিয় থাইদের কাছে। সে দেশের ‘নাম ডক মাই’ আমের কদর আছে সারা বিশ্বেই। যাঁরা সে দেশে গেছেন, তাঁরা কাঁচামিঠা আম নিশ্চয়ই খেয়ে দেখেছেন।

ফিলিপাইন

কারাবাও
ছবি: উইকিপিডিয়া

ভারতীয় আলফানসো আমের পরেই যে আমটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছে, তা হলো ফিলিপাইনের কারাবাও বা কালাবাউ। মিষ্টতার নিরিখে গিনেস বুকে প্রথম স্থান অধিকারী এই আম সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে রপ্তানি হয়। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ভেপার হিট ট্রিটমেন্ট বা বাষ্প-তাপনের মাধ্যমে জীবাণুনাশের নিশ্চয়তা থাকায় ফিলিপাইনের আম নিশ্চিন্তে আমদানি করে থাকে সব দেশ।

জাপান

মিয়াজাকি আম বা টায়ো নো টোমাগো
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

আমের গল্প বলতে গেলে প্রথমেই জাপানের নাম মনে না এলেও সে দেশেই জন্মায় একেবারে চোখ কপালে তোলা বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম (টায়ো নো টোমাগো); একে এগ অব দ্য সান বা সূর্যডিম্ব। জাপানের মিয়াজাকি অঞ্চলে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সুচারুভাবে উৎপাদিত নিখুঁত এই আমের দাম নিলামে প্রতি কেজি তিন-চার লাখ টাকা অবধি হাঁকা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও এই লালচে বেগুনি সুন্দরী সূর্যডিম্ব আমের চাষ শুরু হয়ে গেছে সীমিত পরিসরে। তবে দাম রাখা হয়েছে প্রতি কেজি ছয় হাজার টাকা।

মেক্সিকো

আতাউল্ফো
ছবি: উইকিপিডিয়া

ফিলিপাইনের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে আমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া মেক্সিকানদের জীবন এখন আম ছাড়া যেন অর্থহীন। মেক্সিকোর রাস্তার ধারে সর্বত্র আমাদের দেশে ফুলের মতো করে কাটা আমড়ার মতো কাঠিতে বেঁধানো সোনা রো আম রীতিমতো নুন–মরিচ ছিটিয়ে বিক্রি হয়। আমের ওপরে ছড়ানো এই বিশেষ নুন–মরিচ আর শুকনো লেবুচূর্ণের মিশ্রণকে তাজিন বলা হয়। ফুলের মতো করে কাটা আস্ত আম খাওয়ার জন্য মেক্সিকানরা বিশেষ ম্যাংগো ফর্ক অবধি ব্যবহার করেন। সে দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় আতাউল্ফো আম ছাড়াও ক্রিওলো, ম্যানিলা ম্যাংগো ইত্যাদি জাতের আম সালসা, তাকো, গুয়াকামোলেসহ মেক্সিকান বিভিন্ন পদে ব্যবহার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আমেরিকা

হেডেন আম
ছবি: উইকিপিডিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, মায়ামি, হাওয়াই, পুয়ের্তোরিকোসহ বেশ কিছু ক্রান্তীয় গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলে বেশ আম জন্মায়। আবার দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, চিলি, পেরু, কলম্বিয়া এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলের জামাইকাও আম উৎপাদনের দিক থেকে এগিয়ে। ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় জাত হেডেন, কেন্ট, কেইট, টমি অ্যাটকিন্স ইত্যাদি আম এখন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় সবার পছন্দের শীর্ষে। এই অঞ্চলের আমগুলো দেখতে খুবই বর্ণিল আর পিচ ফলের মতো রসাল ও আঁশমুক্ত হয়।

ইউরোপ
বিশ্বের আম আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপের দেশগুলোই শীর্ষে অবস্থান করছে। যুক্তরাজ্যের বর্তমান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের খুব পছন্দের তালিকায় থাকা আম রাজপ্রাসাদে মজুত থাকে সব সময়। বিলাতি ডেজার্ট ম্যাংগো ফুল ও ম্যাংগো ট্রাইফেলের প্রধান উপাদানই আম।

ম্যাংগো ফুল
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

এ ছাড়া ইউরোপের সব দেশেই তাজা ফলের সালাদে আম, আমের বিভিন্ন মিষ্টান্ন ও আইসক্রিম এবং ম্যাংগো চাটনিও খুব জনপ্রিয়। ইউরোপে একমাত্র স্পেনেই আম হয়। তবে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলো মূলত ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ব্রাজিল ও আইভরি কোস্ট থেকেই আম আমদানি করে থাকে।

আমের সুমিষ্ট আর রসাল স্বাদ আর মনমাতানো বর্ণগন্ধের জাদু এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ হয়ে আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া অবধি ছড়িয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের উৎপাদিত আম অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করলেও আইভরি কোস্ট, মালি, সেনেগালসহ অনেক আফ্রিকান দেশ আম রপ্তানি করে। আবার এদিকে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফ্রুট ফ্লাই বা আমের পোকা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বহুদিন ভারতীয় আলফানসো আম আমদানি বন্ধ রেখে সাম্প্রতিক কালে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় আমাদের সাতক্ষীরার হিমসাগর আমও ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানির তোড়জোড় চলছে।

অ্যানজি
ছবি: উইকিপিডিয়া

আবার সেই সঙ্গে নানা দেশের নানান জাতের বৈচিত্র্যময় সব আমের ব্যাপারে আমাদের দেশে সবার মধ্যে খুব আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশে এখন শৌখিন বাগানিরা বিদেশি জাতের কিউজাই, পালমার, ব্রুনাই কিং ও ব্যানানা ম্যাংগো চাষ করে সফলতা পাচ্ছেন। আর এ কথা বলার অপেক্ষা থাকে না, পৃথিবীর সর্বত্র আমের এই বিশ্বজয়ের গৌরব পৃথিবীর সব দেশের মানুষের আর তাদের খাদ্যসংস্কৃতির। হয়তো একদিন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা হবে এই আমের প্রতি বিশ্ববাসীর একই রকম ভালোবাসার মাধ্যমে।