ওদের বয়ঃসন্ধি কালে সচেতন থাকুন

অটিস্টিক শিশুদের আত্মসচেতন করে তুলতে হবে, যাতে বয়ঃসন্ধিকালে গিয়ে তারা নিজেদের কিছু দায়িত্ব নিতে পারে। ছবি: অধুনা
অটিস্টিক শিশুদের আত্মসচেতন করে তুলতে হবে, যাতে বয়ঃসন্ধিকালে গিয়ে তারা নিজেদের কিছু দায়িত্ব নিতে পারে। ছবি: অধুনা

নদীকে (ছদ্মনাম) দুটো গান দেওয়া হলো, সে বেছে নিল ‘প্রজাপতি এ মন মেলুক পাখনা’ গানটি। ওদিকে সাগর বেছে নিল ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’। নদী ও সাগর দুজনেই জীবনের রঙিন ও বিচিত্র সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর দশটা শিশুর মতো তাদের মন প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে উড়ে বেড়াতে চাচ্ছে, যা দেখছে তা-ই যেন ভালো লেগে যাচ্ছে। মনকে কোনোভাবেই স্থির রাখতে পারছে না।

যাদের কথা আমি লিখলাম তারা দুজনই অটিস্টিক কিশোর-কিশোরী, পার করছে বয়ঃসন্ধিকালের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়। অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা থাকতে পারে এ ধরনের কিশোর-কিশোরীদের আবার বয়ঃসন্ধিকাল কী? তারা তাদের এই সময়কার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন উপলব্ধি করতে পারে কি না?

স্বাভাবিক অনেক মানুষেরই অটিস্টিক কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে নানা নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। এদের যে স্বাভাবিক কিশোর-কিশোরীদের মতো আবেগ-অনুভূতি থাকে, যা হয়তো তারা বোঝাতে সক্ষম হয় না, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না বা বোঝার চেষ্টা করেন না। একজন মানুষ যখন ১০-১৯‍—এই বয়সের মধ্যে যায় তার শারীরিক, মানসিক, আবেগিক সব ধরনের পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের আমূল দৈহিক পরিবর্তন আসে। অন্যদের মতো অটিস্টিক কিশোর-কিশোরীরা বলে বোঝাতে পারে না তাদের কোথায় সমস্যা হচ্ছে বা কী করলে তাদের খারাপ লাগাগুলো দূর হবে। এ বিষয়গুলো মৌখিকভাবে বোঝাতে না পারার কারণেই দেখা দেয় বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, যা সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু অটিস্টিক কিশোর-কিশোরীরা সঠিক নিয়মে সঠিক আচরণ করতে পারে না, সে কারণে তাদের সেসব সমাজস্বীকৃত আচরণ আমাদের শিখিয়ে দিতে হবে।

অন্য ছেলেমেয়ের মতো অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদেরও বয়ঃসন্ধিকালের মতো বন্ধুর সময় পার করতে হয়। সাধারণ মানুষের জীবনে এ রকম পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়মে হয় কিন্তু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোর-কিশোরীদের জন্য এটা একটা যুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে এসব ছেলেমেয়ে এবং তাদের মা-বাবা এক কঠিন সময় পার করেন। সচেতনতার অভাব বা অজ্ঞতার কারণে চরম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। বুদ্ধির বিকাশগত দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা বিশেষ করে অটিজমে আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীরা যেহেতু অনেক ক্ষেত্রে নিজের প্রয়োজন বা পরিবর্তন প্রকাশ করতে পারে না, সে ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা হয়ে ওঠে প্রকট। পরিবার তখন হয়ে উঠতে পারে এ রকম সংকট মোকাবিলার মোক্ষম হাতিয়ার। অভিভাবকের উচিত বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানদের নিয়ে অযথা বিড়ম্বনা না বাড়িয়ে বন্ধু হয়ে সন্তানদের পাশে দাঁড়ানো। কেননা এই সময়টাই তার অঙ্কুরিত হওয়ার সময়। অঙ্কুরেই যাতে বীজ নষ্ট হয়ে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে খেয়াল রাখতে হবে।

এই সময়ে অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের কোন কোন বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে

. আত্ম সচেতন করে তুলুন

* শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর নাম ধরে ধরে শেখান

* পুরুষ-নারীর আলাদা শারীরিক গঠনের ধারণা দিন

* গোপন অঙ্গ সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করুন

. গোপনীয়তা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া

অর্থাৎ কখন এবং কোথায় কীভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয় তা বুঝিয়ে দেওয়া। কখন কী বলা যাবে, কখন যাবে না তা বলতে হবে।

. শারীরিক পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া

বোঝাতে হবে শারীরিক পরিবর্তন একটা সহজাত ব্যাপার।

. ব্যক্তিকে শেখানো

ঋতুচক্র সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দিন। হস্তমৈথুন সম্পর্কেও ধারণা দিন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন²হোন।

নিজের যত্ন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া:

* সেভ করা;

* সুগন্ধি ব্যবহার করা;

* অন্তর্বাস পরিধানের অভ্যাস করা (ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে)।

* টিভি দেখে বা অন্যের কিছু দেখে যাতে না শেখে সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে।

. দূরত্ব বজায় রাখা:

* একে অপর থেকে কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখতে হবে তার ধারণা দিতে হবে;

* অসামঞ্জস্যপূর্ণ জড়িয়ে ধরা বা চুমু দেওয়া সম্পর্কে সচেতন করতে হবে;

* অপরিচিত বা অসৎলোক খুব কাছে চলে এলে তাকে ‘না’ বলতে শেখানো।

* অপরিচিত বা অন্য কেউ যেন নিজ শারীরিক পরিধিতে অসৎভাবে স্পর্শ করতে না পারে, তা বোঝাতে হবে।

. সামাজিক গল্পের মাধ্যমে সঠিক আচরণ শেখানো যেতে পারে

একটা সুস্থ সমাজ গঠনে বয়ঃসন্ধিকাল এবং এ বয়সজনিত সমস্যা নিরসনে যৌনশিক্ষাকে মানুষের চরিত্র এবং আচরণ গঠনের ক্ষেত্রে অন্যান্য শিক্ষার মতোই প্রাধান্য দিতে হবে।


পরিচালক, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন (এসজিসি)