
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নদীর ধারে কাশফুলের দোলা। ভোরের বাতাসে শিউলি ফুলের সুবাস। এসবই মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিতে শরতের ছোঁয়া লাগার কথা! এ ঋতুর অন্যতম আকর্ষণ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব।
উৎসব শুরু হতে প্রায় এক মাস বাকি। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে উৎসব আয়োজনের নানা প্রস্তুতি। আর উৎসবের পূর্ণতা পায় যাঁদের হাতে, সেসব মৃৎশিল্পীর এখন কাটছে ব্যস্ত সময়। মায়ের প্রতিমা গড়তে গিয়ে দম ফেলার ফুরসত নেই তাঁদের। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ আর মহিষাসুর সঙ্গে দেবীর বাহন সিংহকে গড়তে হবে তাঁদের।
প্রতিমাশিল্পীদের ব্যস্ততা টের পাওয়া যায় চট্টগ্রাম সদরঘাট কালীমন্দির প্রাঙ্গণে গিয়ে। সেখানে সহযোগীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে মৃৎশিল্পী সুজন পালের। ঝিনুকের খোলসে তৈরি করা হয়েছে দুর্গার কাঠামো। খড় আর কাদামাটির মিশ্রণে দুর্গার পূর্ণ অবয়ব দিয়ে যাচ্ছেন তিনি একাগ্র চিত্তে। সহযোগীরা ব্যস্ত লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ গড়তে। ব্যস্ততার এ চিত্র চোখে পড়ে নগরের সব প্রতিমালয়ে।
ব্যস্ততার এক ফাঁকে গত শুক্রবার সকালে কথা হয় সুজন পালের সঙ্গে। জানালেন, সময়ের সঙ্গে প্রতিমার গড়নেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তাই মৃৎশিল্পীদের অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয়। মাথায় রাখতে হয় মন্দিরের ঐতিহ্য ও সাজসজ্জার বিষয়টিও। সেভাবই ফুটিয়ে তুলতে হয় প্রতিমার অবয়ব।
সুজন জানালেন, পারিবারিকভাবেই প্রতিমাশিল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁরা। এ শিল্পে তাঁরা এখন তৃতীয় প্রজন্ম। সম্প্রতি মারা গেছেন তাঁর বাবা দুলালকৃষ্ণ পাল। এখন তাঁর সঙ্গী হয়েছেন ছোট ভাই সুশান্ত পাল। নগরের বিভিন্ন এলাকায় ১০টি প্রতিমালয় রয়েছে। এর মধ্যে সদরঘাট এলাকায় পাঁচটি, দেওয়ানজি পুকুরপাড়, হাজারীগলি, চকবাজার, এনায়েত বাজার গোয়ালপাড়া ও কাট্টলী এলাকায় একটি করে প্রতিমালয় আছে। প্রতি মৌসুমে এসব প্রতিমালয়ের প্রতিটিতে ২০ থেকে ৩০টি করে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেন শিল্পীরা।
প্রতিমাশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিমার সাজসজ্জায় আগের তুলনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একসময় আলাদা আলাদা কাপড় ও অলংকার দিয়ে সাজানো হতো প্রতিমা। এখন মাটি দিয়ে সবকিছু সাজানো হয়। কাপড়সহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাটির কাজের দিকে ঝুঁকেছেন আয়োজকেরা।
শিল্পীরা জানান, প্রতিমা তৈরির খরচ প্রতিবছরই বাড়ছে। বর্তমানে আকারভেদে একেকটি প্রতিমা তৈরি করতে ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কোনো কোনো মণ্ডপে লাখ টাকা খরচ করেও প্রতিমা তৈরি করা হয়। কাজভেদে একেকজন কারিগর মৌসুমের প্রতি মাসে আয় করেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। জানা গেছে, চট্টগ্রামে মৃৎশিল্পীদের মূল ব্যস্ততা শুরু হয় ভাদ্র মাসের প্রথম দিকে। মনসা পূজার পর থেকে বিভিন্ন মন্দির থেকে ‘ডাক’ আসতে থাকে তাঁদের কাছে। ডাক পেয়ে তাঁরা ছুটে যান নগরসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। এমনকি ছুটতে হয় তিন পার্বত্য জেলা ও পর্যটন নগর কক্সবাজারেও। এ ছাড়া, কোনো কোনো প্রতিমালয়ে আগেভাগে প্রতিমা তৈরি করে রাখা হয়। বৈশাখে তেমন ব্যস্ততা থাকে না কারিগরদের। প্রতিমাশিল্পীরা জানান, এখন মৃৎশিল্পীরা মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কোনো কোনো মণ্ডপে প্রতিমার কাঠামো তৈরি করে মাটির কাজও শেষ হয়েছে। সপ্তাহ খানেক পর থেকেই শুরু হবে প্রলেপ ও রং দেওয়ার কাজ। সব কাজ শেষ হবে পূজার শুরুর তিন-চার দিন আগেই। এরপর ভক্তরা অপেক্ষায় থাকবে দেবী দুর্গার আগমনের।