কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ লিখেছিলেন, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর...’। কবি যদি কোনো এক বেয়াড়া সমালোচকের মুখোমুখি হতেন, কেমন হতো?
কবি: পারিব না এ কথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার।
সমালোচক: একটি স্বাধীন দেশে বাস করে কীভাবে আপনি এমন একটি কথা বলতে পারলেন, আমি বুঝি না! আপনার কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিই তীব্র আপত্তিকর। বাক্স্বাধীনতার প্রতি সরাসরি হস্তক্ষেপ। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে আমি ‘পারিব না’ বলব নাকি ‘পারিব হ্যাঁ’ বলব, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিবেচনা। এখন আপনি আমাকে যদি খালি টিউবের মধ্যে টুথপেস্ট ঢোকাতে বলেন কিংবা চোখমুখ বন্ধ করে দশতলার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাহলে কি আমি ‘জো হুকুম জাঁহাপনা’ বলে তাই করব? বলুন, উত্তর দিন আমার কথার! আপনার বরং বলা উচিত ছিল, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও মাঝেসাঝে’। আর কেন পারব না সেটা শুধু একবার ভাবব কেন? আমি গালে হাত দিয়ে যতবার ইচ্ছা ভাবতে পারি, আপনার তাতে কী এসে যায়?
কবি: পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা
পার কি না পার কর যতন আবার,
একবারে না পারিলে দেখ শতবার।
সমালোচক: কেন, পাঁচজনের সঙ্গে আমার তুলনা কেন? আমি কি পাঁচজনের খাই না পরি যে তারা যেটা পারবে আমাকেও সেটা পারতে হবে? এ আপনার কেমন বিবেচনা! আমার কি নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা, স্বকীয়তা বলতে কিছু নেই? আর এই তো কিছুক্ষণ আগেই বললেন, কেন পারব না সেটা একবার ভেবে দেখতে। এখন আবার বলছেন, একবার করতে না পারলে এক শ বার দেখতে। একই কবিতায় দুই রকমের কথা কেন?
কবি: পারিব না বলে মুখ করিও না ভার,
ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার।
সমালোচক: আশ্চর্য! আপনাকে কে বলল যে আমি ‘পারিব না’ বলে মুখ ভার করি, হুঁ? আমার শত্রুও তো এমন কথা বলতে পারবে না। ‘পারিব না’ কথাটি আমি সব সময় হাসিমুখেই বলি। শুনুন মশাই, আমার মুখ কি আপনার কথায় চলবে যে আপনি বললেন আর অমনি সব সময় ‘পারিব হ্যাঁ’, ‘পারিব হ্যাঁ’ বলতে থাকবে?
কবি: অলস অবোধ যারা,
কিছুই পারে না তারা
তোমায় ত দেখি না’ক তাদের আকার
তবে কেন পারিব না বল বার বার?
সমালোচক: আপনার নামে তো মশাই মানহানির মামলা দেওয়া উচিত! অলস, অবোধরা কি মানুষ নয়? অথচ আপনি ‘কিছুই পারে না’ বলে কেমন সূক্ষ্মভাবে তাদের খোঁচা দিলেন! আর আমার সঙ্গে আপনার কোন জন্মে দেখা হয়েছে যে, আপনি আমাকে তাদের আকার দেখেন না? আমি কেন বারবার পারিব না বলি, সেই কৈফিয়তই বা আপনাকে দিতে যাব কেন? বলব, এক শ বার বলব!
কবি: জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়
সাঁতার শিখিতে হলে,
আগে তবে নাম জলে...
সমালোচক: আরিব্বাস! খুব যেন জ্ঞানের কথা বলে ফেলেছেন! কখনো কি কাউকে বলতে শুনেছেন যে সে আকাশে কিংবা ঠনঠনে রাস্তায় সাঁতার কেটেছে? আরে মশাই, জলে না নামলে যে কেউ সাঁতার শিখতে পারে না, দুই বছরের বাচ্চাও তো এই কথা জানে। অথচ আপনি এমন ঘটা করে বলছেন, যেন এমনটি বাপের জন্মেও কেউ শোনেনি! আর ছোটবেলায় হাঁটতে শেখার সময় আমরা সবাই-ই এক-আধটু পড়ে-টড়ে যাই। তাই বলে সেটাকে সরাসরি একেবারে ‘আছাড় খাওয়া’ বলবেন? আপনার কাছে পড়ে যাওয়া আর আছাড় খাওয়া এক মনে হলো? বলি, তিলকে তাল না বানালে কি আপনার চলে না?
কবি: আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বারবার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসার।
সমালোচক: মশাই, এত জ্ঞান দিয়েন না তো!