কম বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ?

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করুন
ছবি: প্র স্বাস্থ্য

উচ্চ রক্তচাপ শুধু বয়স্ক মানুষের রোগ—এ ধারণাটি ঠিক নয়। অপেক্ষাকৃত কম বয়সেও (২০ থেকে ৪০ বছরের কম) এটি হতে পারে। দেশের কম বয়সীদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার ঝুঁকি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বেশি। দেশের অল্প বয়সী জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তাঁদের মধ্যে ১৭ শতাংশ পুরুষ আর ৯ শতাংশ নারী। কম বয়সী এই তরুণদের ৬৮ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের কোনো উপসর্গ নেই। অন্য কোনো কারণে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হয়েছে। কাজেই তরুণ বা যুবা বলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকলে চলবে না। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত রক্তের চাপ মাপতে হবে। বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস আছে, তাঁদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোকের কারণ উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশে ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। ৪৭ শতাংশ পুরুষ এবং ১১ শতাংশ নারী জীবনে কখনোই উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপ করেননি। ৫৪ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ওষুধ খান। ৪৩ শতাংশ মানুষ তাঁদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন।

উচ্চ রক্তচাপ

রক্তপ্রবাহের কারণে রক্তনালির দেয়ালে যে চাপ সৃষ্টি হয়, তা–ই রক্তচাপ। স্বাভাবিক অবস্থায় এর পরিমাপ ১২০/৮০। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ খানিক বাড়তে থাকে। সিস্টোলিক বা ওপরের চাপ ১৪০-এর বেশি অন্যদিকে ডায়াস্টোলিক বা নিচের চাপ ৯০-এর বেশি হলে সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়ে থাকে। তবে একবার মেপেই কেউ রক্তচাপের রোগী বলা ঠিক হবে না; একবার বেশি পেলে আবার সুনিপুণ ও যথাযথভাবে রক্তের চাপ মাপতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরপর কয়েকবার যদি রক্তচাপ বেশি ধরা পড়ে, তাহলে রক্তচাপ আছে বলে নির্ণয় করা হয়।

অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ার পেছনে তরুণ প্রজন্মের কিছু বদভ্যাস দায়ী। অতিলবণযুক্ত ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, ওজন বৃদ্ধি ও কায়িক শ্রমের অভাব অল্পবয়সী মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন ধরনের রোগের কারণেও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। এমনকি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে।

নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে
ছবি: প্র স্বাস্থ্য

কম বয়সে হঠাৎ বাড়তি রক্তচাপ পাওয়া গেলে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এর পেছনে কোনো অন্তর্নিহিত রোগ আছে কি না, খতিয়ে দেখা উচিত। যেমন জন্মগতভাবে শরীরের প্রধান রক্তনালিতে সংকোচন বা কোনো সমস্যা যেমন কোয়ারকটেশন অব অ্যাওর্টা, তাকায়াসু আর্টারাইটিস ইত্যাদি আছে কি না। বংশগত কিডনি রোগ, কিডনির প্রদাহ, ত্রুটিপূর্ণ কিডনি, কিডনির রক্তনালির সমস্যা (রেনাল আর্টারি স্টেনোসিস) বা কিডনির টিউমার হলে রক্তচাপ যেকোনো বয়সেই অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে। হরমোনজনিত সমস্যা (যেমন থাইরয়েড, অ্যাড্রিনাল বা পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা), মস্তিষ্কের টিউমার বা জন্মগত ত্রুটি, লুপাস, রক্তনালির প্রদাহ (ভাসকুলাইটিস) ইত্যাদি, দীর্ঘদিন স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবন করলে রক্তচাপ বাড়তি থাকতে পারে।

যেহেতু উচ্চ রক্তচাপের তেমন কোনো উপসর্গ নেই আর অল্প বয়সে কেউ নিয়মিত রক্তচাপ মাপে না, তাই প্রায়ই কম বয়সীদের এই সমস্যা থাকার পরও ধরা পড়ে না। ধরা পড়ে হার্ট ফেইলিউর, স্ট্রোক বা কিডনি সমস্যার মতো জটিলতায়। ছোটদের ক্ষেত্রে কিডনির প্রদাহ উচ্চ রক্তচাপের প্রধানতম কারণ। শিশুদের লালচে প্রস্রাব, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, শরীরে পানি আসা এই সমস্যার লক্ষণ। আবার থাইরয়েডের সমস্যা কিশোরী, তরুণীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। হঠাৎ মুটিয়ে যাওয়া, মাসিকে সমস্যা, গর্ভপাত ইত্যাদি হলে অল্প বয়সে থাইরয়েডের সমস্যার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক আছে কি না, পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

যথাসময়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অতিরিক্ত রক্তচাপের প্রভাবে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর অপরিবর্তনীয় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন।

উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে মেনে চলুন

১. পাতে আলগা লবণ খাবেন না।

২. শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

৩. শাকসবজি ও ফলমূল বেশি খান।

৪. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটাহাঁটি করুন।

৫. নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন।

৬. রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন।

৭. তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।

৮. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ পরিবর্তন বা সেবন বন্ধ করবেন না।

৯. স্ট্রেস এড়িয়ে প্রফুল্ল থাকুন।

১০. রোজ ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুমান।

লেখক: হৃদ্‌রোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সভাপতি, বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন