করোনাযুদ্ধে তরুণ গবেষকেরা

করোনার সময় গবেষণার মাধ্যমে নিজ নিজ জায়গা থেকে অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন চার তরুণ—রিমন পারভেজ, সৈয়দ মোহাম্মদ লোকমান, নিশাত আনজুম ও সাব্বির হাওলাদার। চারজনই চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। চট্টগ্রাম থেকে লিখেছেন সুজয় চৌধুরী।

রিমন পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

জার্নালে রিমনের চার গবেষণা প্রবন্ধ

ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগং–এর স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রিমন পারভেজ। পড়ছেন বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি নিয়ে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার পর থেকেই তিনি শুরু করেন গবেষণার কাজ। কম্পিউটারে বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে আর প্রোগ্রাম লিখে তিনি সার্স কভ-২–এর বিরুদ্ধে টিকা ও প্রতিষেধকের মডেলের নকশা তৈরি করেন। এ পর্যন্ত তাঁর চারটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

রিমন কাজ করছেন ‘রেড-গ্রিন’ গবেষণা দলের সঙ্গে। তাঁদের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় খ্যাতনামা আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি জার্নাল–এ। এ ছাড়া করোনা নিয়ে রিমনের তিনটি গবেষণা টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস গ্রুপের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

রিমন জানান, গবেষণা করে বিজ্ঞানজগতে অবদান রাখা তাঁর ইচ্ছা। মানবকল্যাণে কাজে লাগবে, এমন গবেষণা করাই লক্ষ্য। বর্তমানে তিনি রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটিন নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রোটিনের বিভিন্ন গাঠনিক পরিবর্তন, কার্যগত পরিবর্তন ও সম্ভাব্য ওষুধ প্রস্তুত করাই তাঁর গবেষণার বিষয়।

সৈয়দ মোহাম্মদ লোকমান
ছবি: সংগৃহীত

সার্স কভ-২-এর গঠনপ্রকৃতির খোঁজে লোকমান

কোভিড-১৯ সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি, তার চেয়ে না জানার পাল্লা অনেক ভারী। মানুষের আতঙ্ক, মৃতের সংখ্যা দেখে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ লোকমান। জিন ও ডিএনএ নিয়ে তাঁর পড়াশোনা। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলে না। বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগের পর শুরু করে দেন গবেষণার কাজ।

সার্স কোভ-২-এর গঠনপ্রকৃতি এবং তার ভিন্নতা নিয়ে বায়োইনফরমেটিকসের সাহায্যে গবেষণা শুরু করেন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে লোকমান দেখার চেষ্টা করেন, স্পাইক প্রোটিন কি একই রকম, নাকি মানুষে মানুষে ভিন্নতা দেখা যায়?

লোকমান বুঝিয়ে বললেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী সার্স কোভ-২। মূলত এই স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যেই ভাইরাস দেহের বিভিন্ন কোষে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করে।’ এই স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তন করোনার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাই তাঁর গবেষণায় উঠে আসে। শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের জিনগত গঠন নিয়ে খুব বেশি তথ্য ছিল না। তারপরও ডেটাবেইস থেকে পাওয়া বিভিন্ন দেশের ৩২০টি জিন সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ শুরু হয়। বায়োইনফরমেটিকস ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সাহায্যে এই ৩২০টি সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করা হয়। লোকমানের এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে এলসেভিয়ারের প্রকাশনায় ফ্রান্সের ইনফেকশন, জেনেটিকস অ্যান্ড ইভাল্যুশন জার্নালে।

নিশাত আনজুম
ছবি: সংগৃহীত

নিশাতের গবেষণায় সচেতনতার খোঁজ

করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কতটুকু—এ প্রশ্ন প্রথম থেকেই ছিল। মানুষ করোনা নিয়ে কতটুকু জানে, জানলেও মানে কি না—তা নিয়ে কাজ করেন নিশাত আনজুম। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। পরে ক্লিনিক্যাল প্লেসমেন্ট এবং গবেষণার সুযোগ নিয়ে ঘুরে আসেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন রেডক্লিফ হাসপাতাল থেকে। মাহিদুল অক্সফোর্ড রিসার্চ ইউনিটের বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান তিনি।

দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ নিয়ে সচেতনতা কেমন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা কতটুকু সতর্ক, বিভিন্ন তথ্য কীভাবে কাজে লাগছে—এসব নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক তাহমিনা বানু ও আনোয়ারুল করিম একটি গবেষণা করছিলেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানেই কাজ করেন নিশাত। তাঁদের এই কাজ আন্তর্জাতিক জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন–এ প্রকাশনার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।

নিশাত বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় আমরা পেয়েছি, দেশে কোভিড-১৯ বিষয়ে ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ সচেতন। এপ্রিল মাসের দিকে এই গবেষণা করেছিলাম।’ গবেষণার জন্য দেশের প্রায় আড়াই হাজার মানুষের কাছ থেকে কোভিডসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন তাঁরা।

সাব্বির হাওলাদার
ছবি: সংগৃহীত

করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের চেষ্টা সাব্বিরদের

করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের চেষ্টায় রাত-দিন পরিশ্রম করছেন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। পরিশ্রম করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাওলাদারও।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফারহানা রুমঝুম ভূঁইয়া ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে সাব্বির করেছেন গবেষণার কাজ। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী তপু রায়হান। তাঁরা মূলত করোনা মহামারি থেকে উত্তরণের জন্য উদ্ভিদের বিভিন্ন বিপাকীয় উপাদান থেকে প্রতিষেধক উদ্ভাবনের সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা করেন।

সাব্বির বলেন, ‘মোট ৮৩টি গোত্রের ২১৯টি উদ্ভিদের বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছি আমরা। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি, ৭১টি গোত্রের ১৪৯ উদ্ভিদ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে।’ ইতিমধ্যে এই গবেষণা ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেডিসিন নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।