কলার–কাহিনি

কলারেও আছে ভিন্নতাকৃতজ্ঞতা: ক্যাটস আই, ছবি: খালেদ সরকার

শার্টের ছোট একটি অংশ। এটিরও আছে অনেক কাহিনি। জেনে নেওয়া যাক কলারের অতীত, বর্তমান,ভবিষ্যত।

শার্ট তো গোটা দুনিয়ায় জনপ্রিয় পোশাক। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পরিবর্তনের মাধ্যমে ফ্যাশন ও স্টাইলে নিজের জায়গা পোক্ত করেছে এ পরিধেয়। শুরুতে শার্ট কেমন ছিল বা পোশাকটির অন্যান্য অনুষঙ্গ যেমন কলার, কাফ, বাটন লাইন, বোতাম ইত্যাদির অবস্থান কেমন ছিল, সে প্রশ্ন চলে আছে। ইতিহাস বলে, খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগেও মিসরে শার্টের প্রচলন ছিল। তবে সেগুলো বর্তমান সময়ের মতো ছিল না। অবাক করা তথ্য হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এর ব্যবহার ছিল পুরুষের অন্তর্বাস হিসেবে। এরপর ফ্যাশনের পরিবর্তিত ধারায় ধীরে ধীরে এতে যোগ হয় অন্যান্য অংশ।

মূলত শার্টে কলার যোগ হওয়ার পরই পোশাক হিসেবে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। আলবানি ইনস্টিটিউট অব হিস্ট্রি অ্যান্ড আর্টের একটি গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮২০ সালে প্রথম শার্টের সঙ্গে কলার পরা হয়, তা–ও আলাদাভাবে, অর্থাৎ সে সময় শার্টের সঙ্গে কলার সেলাইয়ের মাধ্যমে যোগ করা ছিল না। সে সময় এগুলো তৈরিও হতো আলাদাভাবে এবং বিক্রিও হতো আলাদা। এমনকি শার্টে কাফও যোগ হয়েছে ১৮৪৫ সালের পর।

বর্তমান সময়ে পুরুষের ফ্যাশনের সব ধারাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে শার্টের কোনো না কোনো ধরন। আর এ ধরনগুলোও নির্ধারণ হয় কাট, প্যাটার্ন ও কলারের মাধ্যমে। দ্য মডার্ন টেইলর আউটিফটার অ্যান্ড ক্লোদার বইয়ে প্রায় ৭০ ধরনের কলারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তবে দ্য বিজনেস ইনসাইডার-এর একটি নিবন্ধে উল্লেখ মেলে, যত দিন গিয়েছে পুরুষের শার্টের কলার, ততই ছোট ও চিকন হয়েছে। তবে নৈমিত্তিক (ক্যাজুয়াল), আনুষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক—এমন ধরনের শার্টের ওপর নির্ভর করেও কলারের আকার ও আয়তন পরিবর্তিত হয়েছে। তাদের মতে, এই শতাব্দীর পুরুষেরা মূলত ছয় ধরনের কলার বেশি ব্যবহার করে। যেগুলো হলো স্প্রেড, ফরওয়ার্ড পয়েন্ট, ট্যাব, কাট অ্যাওয়ে, বাটন ডাউন ও ক্লাব। এর মধ্যে স্প্রেড, ফরওয়ার্ড পয়েন্ট ও বাটন ডাউন কলার স্যুট, ব্লেজার বা জ্যাকেটের সঙ্গে বেশি মানানসই। যাঁদের একটু ঐতিহ্যবাহী আনুষ্ঠানিক ধারা পছন্দ, তাঁরা স্যুট-টাইয়ের সঙ্গে ফরওয়ার্ড পয়েন্ট কলারের শার্ট পরতে পারেন।

স্প্রেড কলার
মডেল: আজিম–উদ–দৌলা

গত শতাব্দীর শেষ দুই বা তিন দশক জনপ্রিয় ছিল ট্যাব কলার, যা আবার চলতি ধারায় ফিরে আসে জেমস বন্ড সিনেমার মাধ্যমে। সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া এই সিরিজের স্কাইফল ও স্পেকট্রা সিনেমা দুটিতে ট্যাব কলারের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। এমনকি জেমস বন্ডের পরবর্তী সিনেমা নো টাইম টু ডাই-এর ট্রেলারেও দেখা গিয়েছে এ কলারের উপস্থিতি। সুতরাং বলা যায়, সহসাই চলতি ধারা থেকে বিদায় নিচ্ছে না ট্যাব কলার। তবে যুক্তরাজ্য ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ফ্যাশন সচেতন ব্যক্তিদের কাছে খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি কলারের এ ধরন।

ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ–এর ব্রিটিশ সংস্করণের এক নিবন্ধে ট্যাব কলারকে উল্লেখ করা হয় বিজনেস কলার হিসেবেও। তাদের মতে, উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই এ কলার বেশি পছন্দ করে। আর ক্যাজুয়াল শার্টের সঙ্গে ট্যাব কলার অনেকটাই বেমানান। এ জন্য কলারটির জনপ্রিয়তাও অনেক কম বলে মনে করে ফ্যাশন ম্যাগাজিনটি।

ক্যাটস আইয়ের পরিচালক ও ডিজাইন বিভাগের প্রধান সাদিক কুদ্দুস জানান, গতানুগতিক সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তনেই একই চেহারার শার্টের ক্যানভাস পাচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ভিন্নতা বেশি আসছে বডি প্যাটার্ন ও শার্টের কলার কাটে। শার্টের জনপ্রিয় কলারের কাটের মধ্যে বান কলার, পিন কলার, ট্যাব কলার, বাটন ডাউন কলার, এস্প্রেড কলার, ক্ল্যাসিক সেমি–স্প্রেড, কাটওয়ে কলার বেশি ব্যবহার হয়। ছেলেদের শার্টে সূক্ষ্ম পরিবর্তন আনা হচ্ছে মূলত সময়ের সঙ্গে মিল রেখে।

ক্যাটঅ্যাওয়ে কলার
পয়েন্ট কলার

ক্যাজুয়াল স্যুট বা স্পোর্টস জ্যাকেট ও ব্লেজারের সঙ্গে পরার জন্য বাটন ডাউন কলার বেশি মানানসই। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অফিসে আনুষ্ঠানিক ও ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে এ কলারের শার্টের কদর বেশি। যে ধারাবাহিকতা দেখা যায় আমাদের দেশেও। বাটন ডাউন কলার নিয়ে অনেক স্টাইলিস্টদের মধ্যে রয়েছে বিতর্ক। অনেকে বলে, এটি বেশি মাত্রায় ঐতিহ্যবাহী। আবার অনেকের মতে, এটি খুবই ক্যাজুয়াল। অধিকাংশ স্টাইলিস্ট একে ক্ল্যাসিক ধারায় দেখতে চায়। এর অবশ্য বেশ কিছু কারণও রয়েছে।

ইতিহাস বলে, ১৮৯৬ সালে এ কলার শুরু হয় ইংল্যান্ডে পোলো খেলোয়াড়দের ড্রেস কোডের অংশ হিসেবে। নানা সময়ে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও এর জনপ্রিয়তা ছিল সব সময়। কেননা, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যেকোনো ধরনের স্টাইল ধারায় এটি দারুণ মানায়।

আনুষ্ঠানিক শার্টের কলার
ন্যারো স্প্রেড কলার

বাটন ডাউন কলারের আরও একটি জনপ্রিয় ধরন হচ্ছে লুকানো বাটন কলার। দুটি কলারের মূল পার্থক্য হচ্ছে একটিতে বোতাম দৃশ্যমান, অন্যটিতে নয়। স্প্রেড কলার, বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত শার্টের কলার। আনুষ্ঠানিক, ব্যবসায়িক, ক্যাজুয়াল, অক্সফোর্ড, ড্রেস শার্ট—যে ধরনের শার্টই হোক না কেন, স্প্রেড কলারের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এর অনেকগুলো ধরনও রয়েছে যেমন ইংলিশ স্প্রেড কলার, কাট অ্যাওয়ে স্প্রেড কলার, উইনসর স্প্রেড কলার, ভার্সিটি স্প্রেড কলার, সেমি স্প্রেড কলার, স্মল স্প্রেড কলার ইত্যাদি।

ফ্যাশন ব্র্যান্ড জেন্টল পার্কের চিফ ডিজাইনার শাহাদৎ চৌধুরী বললেন, শার্টে এখন অনেক নতুনত্ব এসেছে। কলারেই আছে বিচিত্র সব ডিজাইন। ন্যারো কলার, ব্যান্ড কলার তো আছেই, মাঝে গেঞ্জি কলারও যুক্ত হয়েছে শার্টে, তবে তা জনপ্রিয়তা পায়নি। সাদাসিধে ক্ল্যাসিক কলারে সুই-সুতার কাজও চলছে বেশ। আদতে পরিচিত শার্টগুলোই রং, নকশা আর কলার নকশার কাটের পরিবর্তনে পাচ্ছে নতুন নতুন চেহারা।

কখনো কখনো কিছু বিশেষ কলার খুব কম সময়ের জন্যও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফ্যাশন চলতি ধারায় যেগুলো স্থায়ী না হলেও কয়েক বছর পরপর এগুলো ঘুরেফিরে আসে বারবার। যেমন কিউবান কলার, স্টিফ কলার, ক্লাব কলার, স্পেয়ার কলার, স্কয়ার কলার, কাট অ্যাওয়ে কলার, পিন কলার, ইতালিয়ান কলার, ম্যান্ডারিন কলার, ব্যান্ড কলার ইত্যাদি। বিভিন্ন সিনেমা, টিভি সিরিজ, ওয়েব সিরিজ বা ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমেও কিছু কলার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন ২০১৩ সালে শুরু হওয়া টিভি সিরিজ পিকি ব্লাইন্ডারসের মাধ্যমেও বেশ কয়েকটি কলার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ডিটাচেবল স্টিফ কলার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গত শতাব্দীর শুরুতে এ কলার ছিল দারুণ জনপ্রিয়। টিভি সিরিজটির মাধ্যমে যা চলতি ধারায় ফিরে আসে এ দশকে। অনেক ফ্যাশনবোদ্ধার মতে, পিকি ব্লাইন্ডারসের মাধ্যমে ১৯২০ সালের অনেক ফ্যাশনই ফিরে এসেছে এ সময়, বিশেষ করে শার্ট কলার।

অনলাইন ফ্যাশন ম্যাগাজিন জেন্টেলম্যানস গ্যাজেট–এর মতে, টিভি সিরিজটিতে ২০ ধরনের শার্টের কলার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া কিউবান কলার, ক্লাব কলার, আপটার্নড কলারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কখনো কখনো। বর্তমান সময়ে ক্যাজুয়াল শার্টে ব্যান্ড কলার খুবই জনপ্রিয়। একে স্ট্যান্ড আপ কলারও বলে। এ কলারের শুরু চীনে। স্লিম ফিট শার্টের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ কলার। ব্যান্ড কলারকে অনেকে ম্যান্ডারিন কলারের স্লিম ভার্সনও বলে। ম্যান্ডারিন কলারের উৎপত্তি মূলত চীনে। দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোতে এ কলার একধরনের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তাদের যেকোনো ঐতিহ্যবাহীপুরুষ পোশাকেই এ ধরনের কলার দেখা যায়। আমাদের দেশেও এর চল আছে। কখনো সেটা বাড়ে, কখনো কমে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুও ম্যান্ডারিন কলার স্যুট পরতেন।