কাচের স্বর্গ!

সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কাচের দরজা আপনা-আপনি খুলে যায় এই প্রযুক্তির কথা জানি। আমাদের দেশেও বড় কোনো মার্কেট বা দোকানে এ রকম ব্যবস্থা আছে, দেখেছি। কিন্তু কাচ কত প্রকার ও কী কী এ বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কাচের সিঁড়ি বেয়ে আশাহি গ্লাস কোম্পানির কাচের জাদুঘরের একতলা-দোতলা ঘরে সেই বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম। ১ দশমিক ১ মিলিমিটারের পাতলা একটি কাচের ওপর ১৭৫ গ্রাম ওজনের একটি লোহার বল ফেলা হলো, ভাঙল তো না-ই, সামান্য একটি আঁচড়ও লাগল না তাতে। বরং ‘কাচের স্বর্গে’ থাকা মানে যে ক্ষণস্থায়ী সুখের আবাস—এ ধারণাটিই ভেঙে গেল আমাদের।

টোকিও শহর তো বটেই, পুরো জাপানে এখন এ রকম কাচের স্বর্গে বাস করছেন অধিকাংশ মানুষ। যেমন আমাদের দেশে দরজা-জানালায় যেসব ফ্লোট কাচ ব্যবহার করা হয়, তা ভেদ করে ঘরে সূর্যের আলো ঢুকবে ৭০ শতাংশ, কিন্তু তাপ ঢুকবে তার চেয়ে বেশি। কিন্তু জাপানসহ ইউরোপ-আমেরিকায় এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ‘লো-ই’ কাচ, যাতে আলো ঢুকছে ৯০ শতাংশ, কিন্তু তাপ ঢুকছে মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এতে পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু ঘর উত্তপ্ত হচ্ছে না বলে বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হচ্ছে। এ ছাড়া লো-ই দুই স্তরের কাচও দেখা গেল জাদুঘরে। এই কাচের দুটি স্তরের মাঝখানে রয়েছে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, যাতে আছে একদিকে সূর্যের আলোর তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা, অন্যদিকে বিদ্যুতের সাশ্রয়। বহুতল ভবনের জন্য সোলার প্যানেল সংযুক্ত কাচও আছে। ভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, বাইরের আলো প্রবেশের পাশাপাশি এই কাচ বিদ্যুৎও উত্পাদন করবে।
আশাহি গ্লাস কোম্পানির কর্মী মিসাউ মিজিনু জানালেন, প্রায় ৪০০ ধরনের কাচ রয়েছে এ জাদুঘরে। চোখ ধাঁধিয়ে দেয় সেই কাচের বৈচিত্র্য। নানা রঙে ও আকৃতিতে খাজ কাটা কাচগুলো কখনো রুবি ও নীলা পাথর, কখনো বা হীরক খণ্ডের মতো দীপ্তি ছড়াচ্ছে। সুদৃশ্য নকশার কারণে ভবনের সৌন্দর্য যেমন বাড়াচ্ছে সেই কাচ, আবার সূর্যের আলোর তারতম্যের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে রং ও নকশা। অর্থাৎ সকালের তীব্র আলোতে ভবনটির চেহারা এক রকম, বিকেলে বা রাতে বদলে যাচ্ছে সেই রূপ।
ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী তিন জাতের কাচ উত্পাদন করে আশাহি—আর্কিটেকচারাল, অটোমেটিভ ও ইলেকট্রনিকস। আর্কিটেকচারাল কাচ ব্যবহৃত হয় ভবন ও অন্যান্য স্থাপনায়। অটোমেটিভ কাচ যানবাহনের দরজা-জানালায় আর ইলেকট্রনিকস কাচ ব্যবহৃত হয় স্মার্টফোন, টিভি স্ক্রিন, ক্যামেরা, চশমা ইত্যাদিতে। দামি গাড়ির দরজা-জানালার কাচে আরও কত রকম বৈচিত্র্য আনা যায় তার গবেষণা চলছে। ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, বিশেষ করে মুঠোফোনের টাচ স্ক্রিন বা এলইডি টিভির পর্দাকে আরও কী নতুন মাত্রা দেওয়া যায় তারও পরীক্ষার-নিরীক্ষার শেষ নেই।

কাচের ভেলকি
টোকিওর পথে পথে দেখেছি কোমল পানীয়সহ নানা রকম পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাচে ঘেরা বাক্সে। সেখানে দোকানি নেই। কাচের পর্দায় বিভিন্ন সামগ্রীর ছবি ভেসে উঠছে। গ্রাহক প্রয়োজনমতো বাটনে চাপ দিয়ে মূল্য পরিশোধ করলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তাঁর হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সামগ্রী। এই পুরো ব্যাপারটিই ঘটছে কাচের ভেলকিবাজিতে। কাচের ভেতর দিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেখা, মূল্য ও গুণাগুণ পরখ করা, স্মার্টফোনের মতো কাচের বাটনে চাপ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সামগ্রী তুলে নেওয়া—এত সহজে ব্যাপারটি ঘটে যায় যাতে দোকানির উপস্থিতির প্রয়োজনই পড়ছে না। পুরো ব্যবস্থাটি কীভাবে ঘটে তা-ও প্রদর্শিত হলো জাদুঘরে। স্মার্ট গ্লাস থেকে পছন্দের গান শোনা যায়—এমন অদ্ভুত তথ্যও জানা গেল।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে আমরা গিয়েছিলাম টোকিও স্কাই ট্রি দেখতে। ৩৬৫ মিটার উঁচু সেই ‘আকাশবৃক্ষ’ থেকে পুরো টোকিও শহরটাই দেখা যায় এক নজরে। সন্ধ্যায় টোকিও শহরের বিভিন্ন ভবনে জ্বলে উঠল আলো আর আকাশের অগুনতি তারার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সেই আলোর বিচ্ছুরণ দেখে বোঝা গেল এখানেও সেই কাচের জাদু। ভবনগুলোতে ব্যবহৃত কাচের কারণেই এভাবে নানা মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে মোহনীয় আলো।
কথা প্রসঙ্গে একবার বাংলাদেশের কাচ উত্পাদক প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমির হোসেন বলেছিলেন, ‘কাচের ব্যবহারের সঙ্গে মানুষের রুচি, আভিজাত্য ও অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্য বোঝা যায়। যেমন ঢাকা শহরে কাচের ব্যবহার আর একটি মফস্বল শহরের কাচের ব্যবহার একই রকম নয়, তেমনি টোকিও, নিউইয়র্ক বা উন্নত শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকা শহরের কাচের ব্যবহারেরও তুলনা চলে না।’
তাঁর কথার যথার্থতা উপলব্ধি করলাম টোকিওর কাচের স্বর্গ দেখে। তবে বিশ্বায়নের যুগ বলে কথা। আজ যা টোকিওতে দেখেছি, কাল তা ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের শহরগুলোতে দেখব না—এ কথা কে বলতে পারে!