কারও ফুফুআম্মা, কারও খালাম্মা, আত্মীয় তিনি সবার

সুফিয়া কামাল

‘২০ জুন আপনার জন্মদিন। জন্মদিন নিয়ে কিছু বলবেন?’
আজ যদি কবি সুফিয়া কামালকে সরাসরি এই প্রশ্ন করার সুযোগ পেতাম তাহলে জবাবে তিনি যা বলতেন তা ধারণা করে নিতে পারি।
‘আমার আবার জন্মদিন। শরীরটা ভালো যায় না। বাড়ি থেকে বের হতে পারি না। সমাজের কোনো কাজেই তো লাগি না। জন্মদিন নিয়ে কথা বলতে লজ্জা লাগে।’

অথবা হয়তো বলতেন, জন্মদিনে আমি এত মানুষের এত ভালোবাসা পাই, ফুলে ফুলে ভরে যায় আমার বারান্দা। কিন্তু আমি তো কিছুই করে যেতে পারলাম না। এতকাল রাজপথে হেঁটে এখন দেখছি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই আছি। এ দেশের মেয়েদের মুক্তিও হলো না। মাঝে মাঝে মনে হয় এত ভালোবাসা পাই, কিন্তু আমি কি সবাইকে ঠকিয়ে গেলাম!

সুফিয়া কামাল

কবির উত্তরগুলো ভেবে নিলাম, একেবারেই ধারণা থেকে নয়। সুফিয়া কামাল পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর। তাঁর আগের টানা কয়েকটি বছর তাঁর জন্মদিনের আগে তাঁকে নিজের জন্মদিন নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ হয়েছে আমার পেশাগত কারণে। ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলো পত্রিকার পাতায় ২০ জুন তাঁকে নিয়ে লেখার সৌভাগ্যও হয়েছে বছর–বছর। সেসব পুরোনো লেখা পড়লে দেখা যায়, একই সঙ্গে মমতাময়ী এবং দৃঢ়চিত্তের এই মানুষটি নিজের জন্মদিন নিয়ে ঘুরেফিরে কুণ্ঠিত আর সংকুচিত কণ্ঠে এমন উত্তরই দিতেন। ব্যক্তিমানুষকে ছাড়িয়ে তিনি সমাজের প্রসঙ্গই আনতেন বারবার।

সকালবেলা নিজের হাতে কেটেবেছে বাড়ির সবার জন্য রান্না করতে ভালোবাসতেন যে মানুষটি, তিনিই আবার বেলা তিনটায় নেতৃত্ব দিতেন জাতির সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা সভার। কখনো তাঁর বারান্দাতেই সমবেত হতেন গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা, বেতের চেয়ার আর মোড়া টেনে বসে সারতেন জরুরি আলাপ, কখনো তিনি নেতৃত্ব দিতেন রাজপথের প্রতিবাদ মিছিলে।
তিনি ছিলেন সবার খালাম্মা, কারও ফুফুআম্মা, কারও বা নানু। হয়তো চলছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জাতীয় সম্মেলন। এরই মধ্যে তিনি পটুয়াখালী থেকে আগত সদস্যের সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, তোর ছেলের পায়ের ব্যথাটা কমেছে? চট্টগ্রামের একজন সদস্যকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমার মা কেমন আছে? এবার তো শীত বেশি পড়ল, কাশিটা বেড়েছিল? মায়ের যত্ন নিয়ো। আবার যখন সরকারের উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জের যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের কর্মসূচি শুরু হলো, তখন মৃদৃভাষী মানুষটি দৃঢ়কণ্ঠে পত্রিকায় বললেন, এটা উচ্ছেদ, পুনর্বাসন নয়। ওপর দিয়ে ওপর দিয়ে মমতা দেখিয়ে পুনর্বাসন হয় না। এতে সমাজে যৌনরোগ আরও ছড়িয়ে পড়বে। আশ্চর্য হয়ে যাই, কেউ কেন মুখ খুলছে না?
সবাই ২০ জুন সুফিয়া কামালের জন্মদিনই মনে রাখে। তবে তিনি নিজের মনের গভীরে রাখতেন বাংলা জন্ম তারিখটাই। ১০ আষাঢ়।
১৯৭১ সালের দিনলিপি নিয়ে তাঁর বই একাত্তরের ডায়েরিতে নিজের জন্মদিন নিয়ে লিখেছেন—
‘গতকাল গেল ১০ই আষাঢ়, আমার জন্মদিন, তাই বুঝি অঝোর ধারা ঝরছে আজও। কিন্তু জন্মদিনটি ছিল আমার নওয়াব বাড়ীর ‘পুন্যাহ’ উৎসবের দিনে। সোমবার বেলা ৩টা আমার জন্ম। ১৯১১-আর আজ ১৯৭১—কি দীর্ঘদিন, দুঃসহ। আর কতকাল এ অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াব। শুধু অভিশপ্তই নয়। কত যে সম্পদও পেলাম। কিন্তু যা চাইলাম তা পেলাম কই। যা আশা করিনি, তা তো আল্লাহ প্রচুর দিলেন। আজ এ অনিশ্চিত জীবন, কোথায় নিশ্চিন্ত সংসার। কোথায় আমার দেশের সন্তান, কোথায় শান্তি। দলে দলে সবাই অজ্ঞাতবাসে কি করে দিন কাটাচ্ছে আল্লাহই জানেন। আজ কদিন কারুর খবর নেই। সারা দিন বোমারু বিমান কোথায় আগুন জ্বালিয়ে আসছে, আতঙ্কিত ঘৃণায় ভরা এ দিন।’
এই দিন ইংরেজি তারিখ ছিল ২৬ জুন। আর ডায়েরি লেখার সময় ছিল রাত ৯ টা।
যে মানুষটা অন্যের দুঃখকষ্টের খবর রাখতেন, স্পর্শ করতেন হৃদয়, গভীর আন্তরিকতায় সন্তান হারিয়ে তিনিও বুকে চেপে রেখেছেন আগুন। লিখেছেন—
‘কে আছে সৌভাগ্যবতী আমার মতন
এক পুত্রহীনা হয়ে শত পুত্র ধন
লভেছি, সৌভাগ্য মোর। শতেক দুহিতা
সারা বাংলাদেশ হতে ডাকে মোরে মাতা
জননী আমার! তুমি করিয়ো না শোক
তুমি আছ পূর্ণ করি সর্বান্তর লোক।’

১৯৭১ সালে তাঁর বড় মেয়ে দুলুর স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চট্টগ্রামে। নভেম্বরের ১৭ তারিখে। এই দুঃখজনক ঘটনায় কবির মন বিক্ষত। লিখলেন কবিতা, সেই কবিতাও ব্যক্তিজীবনের দুঃখ ছাপিয়ে দেশ সমাজ সময়ের কথা বলে—
‘আমার ‘দুলু’র মুখ দেখি আজ বাংলার ঘরে ঘরে
শ্বেতবাসা, আর শূন্য দু’হাত নয়নে অশ্রু ঝরে
বুকে করে সন্তানে
যাপিছে দিবস রাত্রি, কি করে সে কথা
ওরাই জানে।
দেউটি নিভেছে, নীড় হারা পাখী,
পক্ষি মাতার মতো
দু’বাহু প্রসারি আঙলিতে চাহে দামাল দুলালে যত,
ওরা তা মানে না, বক্ষে ওদের জ্বলিছে ক্ষুব্ধানল
পিতৃহারা যে করেছে মোদেরে কোথা
সে দানব দল,
একবার দেখি! গোপনে যে ভীরু সরীসৃপ সম এসে
লক্ষ প্রাণেরে ছোবল মারিয়া বিবরে লুকাল শেষে
একটি ছোবল বিনিময়ে চাহে শতেক আঘাত হানি
বিদারিয়া দিতে ক্রূর দানবে পাষাণ বক্ষ খানি
অশ্রু নিবারি রক্ত চক্ষু ওরা চাহে প্রতিশোধ
ওদের মনের দাবাগ্নিজ্বালা কে করিবে প্রতিরোধ
অভাগিনী মাতো সকাতরে চাহে
আবরি রাখিতে তারে
এখন গোপন শত্রুর দল হানা দিয়ে বারে বারে
পরাজিত-বিদ্বেষে
রক্তের স্রোত বহাইতে চাহে সোনার বাংলাদেশে।’

সুফিয়া কামালের জন্মদিন নিয়ে তাঁর কন্যা সাঈদা কামাল একবার বলেছিলেন, বাড়িতে যে–ই আসত, তাকে ঠিকমতো নাশতা না দিলে মা ভীষণ মন খারাপ করতেন। ২০ জুন জন্মদিনে স্রোতের মতো মানুষ আসত। স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদূত। একবার দুপুরের দিকে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কয়েকজনকে মিষ্টি পানি দিয়েছি, চা দেওয়া হয়নি। মা যে কী মন খারাপ করলেন। তিন দিন বিছানা ছেড়ে ওঠেননি।
আর মায়ের জীবনের শেষ সময়ের কথা বলতে গিয়ে সুলতানা কামাল আরেক দিন বলছিলেন এই কাহিনি, ১৯৯৯ সালের ১৯ নভেম্বর রাতে হাসপাতালে মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছিল। বিছানায় ওঠবস করছিলেন। কথা বলতেও পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাসপাতালের কেবিনে আমাদের সঙ্গে মায়ের পাশে ছিলেন নার্স তুলসী। মা শুধু একবার বললেন, তুলসী খেয়েছে!
১৯১১ সালে বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ নবাব পরিবারে জন্ম নেওয়া ছোট্ট সুফিয়া একদিন সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখেছেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন। পরে নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা এই মানুষটি নিজের গুণে হয়ে গেলেন বাংলাদেশের অভিভাবক। এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষেরাও অসুস্থ সুফিয়া কামালের সঙ্গে দেখা করতে বা তাঁকে পদক পরিয়ে দিতে ছুটে গিয়েছেন তাঁর বাড়ির সেই লাল বারান্দায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন সরকারপ্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার কবি বেঁচে থাকতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পদক দিয়ে আসেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর আমাদের প্রথম আলোতেই লিখলেন—
‘১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমীর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী যে অনুষ্ঠানমালা আমাকে উদ্বোধন করতে হয় সে অনুষ্ঠানে বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তিনি আমাকে বললেন, “আপনার সঙ্গে আমার আগে দেখা হয়নি। আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।”
আমি স্মিত হেসে বললাম, “আমাকে আপনার চেনার কথা নয়, চেনানোর এমন কিছু নেই।”
তার ১৭ বছর পরে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে নিয়োজিত হলাম তখন মহিলা সমিতির (নারীনেত্রীদের একটি দল) একটি প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কথায় কথায় তাঁরা বলেন, “বেগম সুফিয়া কামাল আসতে চেয়েছিলেন। তাঁর শরীর তেমন ভালো নেই বলে আসতে পারেননি।” আমার সময় হবে কিনা না ভেবে বা কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি বললাম, “তাঁকে আমার সালাম জানাবেন। আমি তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করব।” কবির বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর বাড়ির নাম “সাঁঝের মায়া”। আমার বড় ভালো লাগল তার পরিবেশ। কবির আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ ও ধন্য হলাম।’ (জননী গরীয়সী, ২৬ নভেম্বর ১৯৯৯)

এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা! যাঁর সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল তিনিই ভাবতেন, খালাম্মা আমাকে খুব স্নেহ করেন। কিংবা ফুফুআম্মা আমাদের মায়ের মতো। তাই তো তাঁর মৃত্যুর পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের গাছপালা ঘেরা ‘সাঁঝের মায়া’ বাড়িটি যখন ভরে গেল মানুষে মানুষে, সবুজ বাগান, লাল বারান্দা, ঘরের কোণ, গেট ছাপিয়ে বড় রাস্তা, তখন হঠাৎ খবর এল রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আসবেন এ বাড়িতে কিছুক্ষণের মধ্যে, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যরা পরিবারের মানুষদের বললেন, আত্মীয় ছাড়া অন্যদের চলে যেতে বলুন নিরাপত্তার স্বার্থে। পরিবার থেকে তখন উত্তর দেওয়া হয়েছিল, এখানে উপস্থিত সবাই সুফিয়া কামালের আত্মীয়, অনাত্মীয় কেউ নেই!

  • লেখাটি ২০১৬ সালে প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। আজ সুফিয়া কামালের জন্মদিনে আবার প্রকাশ করা হলো।