কিছুদিন পরের কথা

বেশ কিছুদিন আগের কথা, বার-তারিখ খেয়াল নেই। শীতের সকাল, শুধু এতটুকু মনে আছে। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে নাশতা করছি, মা সামনে বসা। নাশতা শেষ হওয়ার পর তিনি বললেন ধানমন্ডি যেতে হবে। কোনো এক হাসপাতালে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ভর্তি আছে, অল্প বয়সী একটা ছেলে, তাকে দেখতে। দরিদ্র মানুষ, ঢাকায় এসে অপারেশন করতে গিয়ে টাকা শেষ, হাতে কিছু টাকা পৌঁছে দিতে হবে।
ক্লাস শেষ করে মাকে সঙ্গে নিয়ে ওই দিন রাতের বেলা আত্মীয়কে দেখতে গেলাম ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের দিকে। ষোলো-সতেরো বছরের একটা ছেলে, করুণদশায় শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায় (তার রোগের নামটা ভুলে গেছি)। নড়াচড়া করতে তার যে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, সেটা আর বলার বাকি রাখে না। ছেলেটা নাকি মানসিকভাবেও অসুস্থ, মানে তার বুদ্ধির বিকাশ ঠিকমতো ঘটেনি। শরীর ষোলো-সতেরো বছরের ছেলের হলেও মস্তিষ্কের বিকাশ নয়-দশ বছরের শিশুর মতো। ছেলেটাকে দেখে মায়া লাগল, প্রচণ্ড মায়া লাগল। মা-বাবার সঙ্গে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য এসেছে। আমি যতক্ষণ হাসপাতালে ছিলাম, শুধু ছেলেটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমার জায়গায় যে কেউ থাকলে ওইভাবেই তাকিয়ে থাকত। দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের সমন্বয় দেখতে বোধ হয় ওই রকমই হয়। ছেলেটার বাবা হাসপাতালের কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। ছেলেটার মাকে মোটামুটি শক্ত একজন মানুষ মনে হলো, ছেলের এই দশাতেও তিনি হাসিটা ধরে রাখতে পেরেছেন। বেডের পাশে কাগজের ঠোঙা থেকে একটা কমলা বের করে আমাকে সাধলেন এবং আমি যতই না করি, উনি ততই জোর করতে থাকলেন। মনে হচ্ছিল আমাকে কমলা খাওয়ানোই যেন তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য! অমায়িক মহিলা।
বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম হাসপাতালে। চলে আসার আগে নিচে কোনো রেস্টুরেন্ট খোলা আছে কি না খুঁজে দেখলাম, হাসপাতালের খাবার খেয়ে খেয়ে ছেলেটা নিশ্চয়ই বিরক্ত। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ। একটু দূরে গিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট খোলা পাওয়া গেল, সৌভাগ্যক্রমে সেখানে বিরিয়ানিও পাওয়া গেল। দুই প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে নিয়ে এসে ছেলেটার মায়ের হাতে দিয়েছিলাম।
কিছুদিন পরের কথা। সেদিনও ড্রয়িংরুমে বসে নাশতা করছিলাম। হাসপাতাল থেকে ফোন এল। ওপাশ থেকে জানাল, ছেলেটা মারা গেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে অনেক গান রচনা করেছেন। তার মধ্যে আমার প্রিয় একটা গান, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু, আনমনে...’
রিফাত-ই-রাব্বি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা