
আমাদের কুকুরের বকলসটি ছিঁড়ে গেছে। বকলসের কোনো দোষ নেই, কুকুরটিকেও দোষ দেওয়া উচিত হবে না। বকলসটির বয়স হয়েছে, আমাদের এই বলবান নামের কুকুরটি যে এখন প্রায় বুড়ো হতে চলল, বকলসটির বয়স তার থেকেও বেশি। বকলসটি ছিল বলবানের মা মদালসার। মা মরে যাওয়ার পর বলবান এই বকলসটি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে। তার আগে পর্যন্ত বলবানের কোনো বকলস ছিল না।
আজ বেশ কিছুদিন হলো বকলসটির খুবই জীর্ণ অবস্থা চলছিল। কিন্তু কিনি কিনি করেও কেনা হয়ে উঠছিল না। কবে সুদূর অতীতে আমার ছোট ভাই বকলসটি কোথা থেকে কিনে এনেছিল। সে-ও অনেক দিন কলকাতায় নেই। কিন্তু আমি জানি না বকলস কোথায় পাওয়া যায়। আমার স্ত্রী-পুত্রেরও এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই।
অথচ একটা বকলস না কিনলেই নয়। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বলবানকে দুই বেলা রাস্তায় একটু নিয়ে যেতেই হয় আর তখন এই অর্ধোন্মাদ প্রৌঢ় কুকুরটিকে বকলসবিহীন গলায় শুধু শিকলে বেঁধে নেওয়া সোজা নয়।
প্রথমে চেষ্টা করেছিলাম ছিন্ন বকলসটি সারাতে। যে চর্মকারের কাছে গিয়েছিলাম তিনি ৫০ পয়সায় সারিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু জিনিসটা হাতে নিয়ে কী ভেবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কার?’ তিনি হয়তো ভেবেছিলেন ওটা কোনো মানুষের গলার, হয়তো ভেবেছিলেন ওটা আমারই গলায় শোভা পায়। তাই যখন শুনলেন ওটা কুকুরের গলার, তিনি বকলসটি দশ হাত দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাঁর কাঠের বাক্সের পাশে দুবার থুতু ফেলে ছি ছি করতে লাগলেন। বললেন, ‘কুকুরের দ্রব্য আমরা স্পর্শ করি না।’ তাঁর উত্তেজনা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম, তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসতে গিয়ে ছেঁড়া বকলসটি উদ্ধার করে আনা হলো না।
সুতরাং, এবার একটি নতুন বকলস সংগ্রহ করতেই হবে। কিন্তু বকলস কোথায় পাওয়া যায়? পাড়ার মোড়ে একটা দোকানে লোহার জিনিসপত্রের সঙ্গে কুকুরের শিকল বিক্রি হয়। সেখানে গিয়ে বকলসের খোঁজ করলাম। তাঁরা বললেন, ‘যদি লোহার বকলস দরকার হয়, তবে অর্ডার দিলে বানিয়ে দিতে পারি। কিন্তু চামড়ার কোনো জিনিস আমরা রাখি না।’ চলে আসছিলাম, তাঁরা আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘লোহার জিনিস যখন যা দরকার হয় আসবেন। চোরের হাতকড়া থেকে পাগল বেঁধে রাখার শিকল—সবই বানিয়ে দিতে পারব।’
‘আপাতত এসব দরকার নেই,’ এই বলে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বাজারে গেলাম। প্রথমে গেলাম চামড়ার স্যুটকেস ব্যাগের দোকানে। কিন্তু তাঁদের কাছে কুকুরের বকলস নেই। তবে তাঁরা বললেন, উল্টো দিকের ফুটপাতে একটা ছোট দোকানে কোমরের বেল্ট বিক্রি হয়, সেখানে খোঁজ করা যেতে পারে। সেখানে গেলাম, দুঃখের কথা, সেখানেও কুকুরের বকলস নেই। ছোট বেল্ট হলে চলবে কি না, বিবেচনা করতে গিয়ে দেখলাম, কোনো মানুষের কোমর, এমনকি কোনো বালকের কোমরও কুকুরের গলার মতো সরু নয়। আর বেল্ট কেটে বকলস বানালে আমাদের বলবানের মর্যাদাহানি হবে।
ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পরের দিন অফিসে এক ভদ্রলোক বললেন, তিনি দেখেছেন চিৎপুরের মোড়ে একটা দোকানে কুকুরের বকলস বিক্রি হয়। অফিস ফেরতা যথাস্থানে গেলাম। কিন্তু কোথায় সেই বকলস-বিপণি? খুঁজতে খুঁজতে দেখি একটা সিঁড়ির ওপরে লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়ে এক ভদ্রলোক তিনটি সদ্য চোখফোটা কুকুরছানা কোলে করে আদর করছেন। তাঁর পায়ের কাছে আরও গোটা কয়েক ছানা শুয়ে রয়েছে, একটু দূরে একাধিক কুকুর, তার মধ্যে একটি নিশ্চয় এই কুকুর শাবকগুলোর জননী, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
আমি বুঝতে পারলাম, এই ভদ্রলোকই পারবেন কুকুরের বকলসের দোকানের হদিস দিতে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা শুনেই ভদ্রলোক খেপে উঠলেন। তাঁর চেঁচামেচি থেকে যেটুকু বোধগম্য হলো, তা হলো যে কুকুরের মতো নিরীহ প্রাণীকে বকলস দিয়ে বন্দী করে রাখা অমার্জনীয় দোষ, শুধু অমানুষেই এ রকম নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে। কুকুরের বকলসের দোকান কোথায় তা তিনি জানেন না, না জানাই ভালো। কারণ, জানতে পারলে তিনি সেই দোকানে আগুন লাগিয়ে দেবেন। ভদ্রলোকের গর্জন শুনে ঘুমন্ত কুকুরগুলো উঠে এসে আমাকে পর্যায়ক্রমে শুঁকতে লাগল। আমি আস্তে আস্তে পিছু হটে শেষে এক লাফে একটা উল্টো ট্রামে উঠে পড়লাম।
পরের দিন সকালে বিছানায় শুয়ে ভাবতে ভাবতে বকলস সম্পর্কে একটা বুদ্ধি এল। ময়দানে অনেক লোক কুকুর নিয়ে আসে, সব কুকুরের গলাতেই বকলস। এদের কারও প্রভুকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে কোথায় সেই রহস্যময় বকলস-ভান্ডার। সুতরাং ময়দানে গেলাম। অনেক কুকুর মন দিয়ে দেখলাম, তাদের গলায় বকলস রীতিমতো পর্যবেক্ষণ করলাম, শেষে একটি চমৎকার অ্যালসেশিয়ান কুকুরের গলায় পিতলের বুটি বসানো কালো চামড়ার ঝকঝকে বকলসটি খুব পছন্দ হলো। মনে মনে কল্পনা করলাম, এই রকম অলংকারে আমাদের বলবানকে কেমন মানাবে। অ্যালসেশিয়ানটির প্রভু একটু দূরেই হাফপ্যান্ট পরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক বিচিত্র উপায়ে দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছিলেন। দৌড়াচ্ছিলেন কিন্তু একটুও এগোচ্ছিলেন না, অতীব কৌশলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখছিলেন। প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষা করার পর তাঁর দৌড় থামল। আমি তাঁর দিকে একটু এগিয়ে গেলাম, কিন্তু আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে অ্যালসেশিয়ানটিকে আমি যখন দেখছিলাম, সে-ও আমাকে দেখছিল। আমি যেই তার প্রভুর দিকে একটু এগিয়েছি, সে আমার ওপর বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিক্ষিত কুকুর, কামড়াল না, আঁচড়াল না কিন্তু তার ধাক্কায় আমি চিত হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড লাগল, ভয়ও পেয়েছিলাম খুব। বিশাল একটা কালো দৈত্যের মতো কুকুর, কে ভয় পাবে না?
কুকুরটির প্রভু আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। কামড়াবে না।’ চিরকাল আমার কুকুরই অন্যদের লাঞ্ছিত করেছে এবং এই রকম স্তোকবাক্য আমি দিয়েছি, আজ এতকাল পরে ঠিক তার বিপরীত হলো।
আমি আস্তে উঠে বসতে যাচ্ছিলাম। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বললেন, ‘আরে সর্বনাশ! এখন উঠতে যাবেন না। দেখছেন না টাইগার কেমন ফুঁসছে। আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আপনি এক কাজ করুন, আস্তে আস্তে ঘাসের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ওই বকুলগাছটার পেছনে সরে যান।’ তিনি অঙ্গুলিনির্দেশ করে প্রায় ১০০ মিটার দূরবর্তী বকুলগাছটি দেখালেন।
প্রাণরক্ষার জন্যে বাধ্য হয়ে আমাকে ভদ্রলোকের নির্দেশ মানতে হলো। এই অবস্থায় বকলসের দোকানের খবর আর নেওয়া হলো না। বুক দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে সুদূর বকুলগাছের নিরাপত্তার দিকে সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম। টাইগার নামক অ্যালসেশিয়ানটি আমার এই পশ্চাদপসরণ হিংস্র দৃষ্টিতে লক্ষ রাখতে লাগল। তার প্রভু মহোদয় ইতিমধ্যে আবার সেই আশ্চর্য স্থির দৌড় আরম্ভ করে দিয়েছেন।
ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আমি মিনিটে এক মিটার গতিতে চলতে লাগলাম। আমার দুই স্থূলাঙ্গিনী প্রতিবেশিনী অতিরিক্ত গোলগাপ্পি কিংবা বাটাটাপুরী ভোজনের ক্যালরি পোড়ানোর জন্যে দ্রুত হাঁটছিলেন ময়দানের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে, আমার এই পরিণতি দেখে তাঁরা থমকে দাঁড়ালেন। ঘাস থেকে মাথা তুলে কী একটা ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছিলাম। টাইগারের স্থির চোখের দিকে চোখ পড়তেই বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেল। আবার গড়াতে লাগলাম।
(তারাপদ রায়: বাঙালি কবি ও গল্পকার। তাঁর রম্যরচনাগুলো তুমুল জনপ্রিয়। তারাপদ রায়ের জন্ম বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে ১৯৩৬ সালে। মারা গেছেন কলকাতায় ২০০৭ সালে।)
কুকুরটির প্রভু আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। কামড়াবে না।’