কুদুম গুহার রহস্যের হাতছানি

টেকনাফের ঐতিহাসিক কুদুম গুহার মুখে দর্শনার্থীরা  প্রথম আলো
টেকনাফের ঐতিহাসিক কুদুম গুহার মুখে দর্শনার্থীরা প্রথম আলো

কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফের পথে প্রায় ৭০ কিলোমিটার গেলে নাফ নদীর তীরে হোয়াইক্যং বাজার। এখান থেকে পশ্চিম দিকে চলে গেছে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা হোয়াইক্যং-বাহারছড়া সড়ক। এই সড়ক ধরে নয় কিলোমিটার গেলে হরিখোলা চাকমাপল্লি। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে দেড় কিলোমিটার হাঁটলেই রহস্যময় কুদুম গুহায় পৌঁছানো যায়।
৪৬ শব্দের গাঁথনি দিয়ে পাঠকদের এক মিনিটে কক্সবাজার থেকে কুদুম গুহায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও বাস্তবে যেতে সময় লাগবে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি কুদুম গুহায় ভ্রমণের আরও একটি বাধা হলো নিরাপত্তা ঝুঁকি। কারণ, গুহায় যাতায়াতের রাস্তায় পড়ে জঙ্গল, যেখানে বিচরণ করে হাতিসহ বহু বন্যপ্রাণী।
ঠিক কখন এই গুহার সৃষ্টি, কেউ জানে না। ইতিহাসের কোথাও এই গুহার বিবরণ নেই। জনশ্রুতি আছে, গভীর বনে তৈংগ্যা পাহাড়ে এই গুহা তৈরি হয় হাজার বছর আগে। ওই সময় এক রাজা (নাম জানা যায় না) জাহাজ থেকে খালাস করা মালামাল মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গটি তৈরি করেছিলেন। অনেকে বলেন, ওই রাজা যুদ্ধের সময় এই সুড়ঙ্গকে গোপন পথ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু আরেক মগ দস্যুর হাতে ওই রাজার মৃত্যু হলে সুড়ঙ্গটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর গাছপালা আর আগাছা জন্মে সুড়ঙ্গটি ভয়ংকর রূপ নেয়। যে কারণে গত ১০০ বছরেও কেউ সুড়ঙ্গটি অতিক্রম করতে পারেনি।
হোয়াইক্যং এলাকার বাসিন্দা জাফর আলম চৌধুরী (৭০) বলেন, প্রায় ১১০ বছর আগে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন এই গুহাটি আবিষ্কার করেন। শিকারিরা এই গুহার প্রবেশমুখে বিশ্রাম নিতেন। বর্তমানে সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে এই গুহার কদর ততই বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও পর্যটকেরা এই গুহায় আসেন অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্যের টানে।
বন বিভাগের সহযোগী সংগঠন—হোয়াইক্যং সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) নেতা হারুন রশিদ সিকদার বলেন, রহস্যময় কুদুম গুহা সংস্কারের পাশাপাশি দেড় কিলোমিটারের হাঁটা পথটি চলাচলের উপযোগী করে তোলা গেলে পর্যটকদের যাতায়াতে সুবিধা হবে।
গত ২৭ এপ্রিল কুদুম গুহা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, গুহার মুখ ধসে পড়ছে। নিচে জমে আছে কোমরসমান পানি। গুহার মুখে আগাছার জঙ্গল। গাছপালা ও আগাছার কারণে ঢেকে গেছে ৪৩ ফুট উঁচু এবং ২৪ ফুট চওড়া গুহার প্রবেশমুখ।
হোয়াইক্যং বনের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, এই গুহার আরেক মুখ রয়েছে তৈংগ্যা পাহাড়ের পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরের তীরে, বাহারছড়া গ্রামে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটার হতে পারে। এই গুহার এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়েছে, বিগত ১০০ বছরে এমন মানুষের দেখা মেলেনি। তবে অনেকে চেষ্টা করেছিলেন গুহার রহস্য ভেদ করার। তাঁদের সবাই সর্বোচ্চ এক মাইল পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছেন।
১৯৮৩ সালে পরিবেশবিদ আলী রেজা খান এই গুহায় ঢুকেছিলেন। তিনি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘গুহার ভেতর যত দূর দৃষ্টি যায় কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। হেডল্যাম্পের আলোয় এক-দেড় কিলোমিটারের বেশি দেখা যায় না। কেবল যে ঘুটঘুটে অন্ধকার তা-ই নয়, ভেতরে কানের পর্দা ছিঁড়ে ফেলার মতো শিসের শব্দ। বাদুড়ের বিষ্ঠার উৎকট দুর্গন্ধ আর দম বন্ধ করা পরিবেশ।’
হোয়াইক্যং আলী আছিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর শীত মৌসুমে অসংখ্য মানুষ এই গুহা দেখতে আসেন। সবার ইচ্ছা গুহার এক মুখ থেকে ঢুকে অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু ঘটনাস্থলে গেলে তা আর হয়ে ওঠে না। তবু এই গুহাটি পর্যটকদের আকর্ষণে পরিণত হচ্ছে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, প্রাচীন সভ্যতার আরেক নিদর্শন হোয়াইক্যং এলাকার এই কুদুম গুহা। এটি সংস্কার করা হলে কক্সবাজারে পর্যটনশিল্পে আরেক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। পর্যটকরা নিরাপদে গুহাটি ঘুরে দেখার সুযোগ পেলে স্থানীয় লোকজনও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।