কোন কাজ নারীর আর কোনটা পুরুষের?
>

বর্তমান সময়ে নারীর কাজ পুরুষের কাজ বলে আলাদা কিছু নেই। নারী ও পুরুষ সবক্ষেত্রে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। তবুও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জন্য কাজ ভাগ করে দেখানোর প্রবণতা দেখা যায়। পাঠ্যপুস্তাকের প্রশ্নেও তা উঠে আসে। কিন্তু কেন?
নারীর কাজ ও পুরুষের কাজের মধ্যে পার্থক্য কী। আলাদা করে কোনো দিন ভাবতে হয়নি। এখন তো নয়ই। যে সময়ে আমরা চলছি, এখন নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই কোনো দিক থেকেই। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন তাঁরা।
পরিবর্তনের এই সময়ে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্টে চোখ আটকে গেল। ফেসবুকের বন্ধুরা বহু শেয়ার করেছেন। উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছে এ বিষয়ে। একটা উত্তরসহ প্রশ্ন—নারীর কাজ ও পুরুষের কাজ পৃথক করা।
উত্তরের ছকে দেখা গেল, ‘নির্বাচন করা, বিমান চালানো, সাঁকো মেরামত, বিচার সালিস করা পুরুষের কাজ। আবার সন্তান ধারণ করা, মাছ কোটা, বিয়েবাড়িতে কাজ করা নারীর কাজ।’ অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে ভালো করে খেয়াল করলাম, যা ফেসবুকে দেওয়া হয়েছে সেটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামের সহায়ক একটি গাইড বইয়ে দেওয়া উত্তর। তাহলে আসল বইয়ে কী আছে? বইটি জোগাড় করলাম। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামের ‘ক্যারিয়ার শিক্ষা’ বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় দেখতে পেলাম বহুল আলোচিত বিষয়টি।
নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় কর্মপত্র-১ এ লেখা আছে নিচের কার্ড সেট থেকে নারী ও পুরুষের কাজ পৃথক করো। সেখানে উত্তর দেওয়া নেই। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন কীভাবে থাকে? তাহলে যাঁরা বই লেখার কাজটি করেছেন তাঁদের মনস্তত্ত্বের মধ্যেই কি বিষয়টি আছে? নারীকে তাঁরা কীভাবে দেখতে চান সমাজে?
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের নেতৃত্বদানের কাজটি করে আসছেন নারীরা। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এমনকি মাত্র শেষ হওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথম নারী মেয়র দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে নির্বাচন করা কার কাজ, সেই প্রশ্ন থাকাই তো অবান্তর।
বিমান চালানোর কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন অনেক নারী সরকারি ও বেসরকারি বিমান চালান। কাজের সুবাদে এক বৈমানিক দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সংসারের কাজ যেমন তাঁরা ভাগাভাগি করে নেন, তেমনি কাজের ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন। সন্তানের দেখভালের দায়িত্বও তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে সেরে নিয়েছেন।
প্রশ্নের উত্তরে থাকা সন্তান ধারণ করা, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কাজটি শুধু পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। বাকি কোন কাজটি নারী ও পুরুষ উভয়ই করতে পারেন না? এমনকি মাছ কাটাকুটির যে কথা বলা হয়েছে, সেটাও তো সঠিক নয়। হয়তো বইয়ের লেখকের অবচেতন মনে হয়েছে যে মাছ কাটা বা হেঁশেল ঠেলা তো আর পুরুষের কাজ নয়। সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও বড় বড় রেস্তোরাঁ ও হোটেলে শেফের দায়িত্ব পুরুষেরাই পালন করেন।
এই ছকে এমন কোনো কাজ নেই, যা নারী-পুরুষ উভয়ে করতে পারেন না। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম এ মান্নান গতকাল সোমবার এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অবগত হয়েছি। বইয়ের একজন লেখক আমাদের এখানকার। বাকিরা বাইরের। আমরা দুঃখিত যে এ ধরনের প্রশ্ন বইয়ে রয়েছে। জেন্ডার সমতাকে সমর্থন করে না এ ধরনের প্রশ্ন। আমরা দুঃখিত। পুনর্মুদ্রণের কাজ শুরু করেছি। ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকব।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তরসহ গাইড বই পড়ার প্রতি একধরনের আকর্ষণ থাকে। এসএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যে বয়স, তখনই যদি মাথা ও মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় যে সমাজে নারীর অবস্থান কেমন হবে। নারীরা সংসার ও ঘর গৃহস্থালির কাজ করবেন, বাকি কোনো কাজ করবেন না, তা তো হয় না।
চিরায়ত প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে আসলে অনেকে বের হতে পারেননি। মানসিকতাই এমন যে নারীরা বাইরের কোনো কাজ করতে পারবেন না। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরীর মতে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও মননের সব দরজা উন্মুক্ত হতে হবে। মূল বইয়ের চেয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গাইড বই-ই পড়ে। ফলে বইগুলোতে কী লেখা হচ্ছে, তা মনিটরিং করা দরকার। যে বয়সের তরুণদের এই বই পড়ানো হচ্ছে, তাতে জ্ঞানের আলো দ্বারা তাঁরা বিকশিত না হয়ে কূপমণ্ডূক হয়ে যাবে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘ভয় হলো, এতে না আবার মৌলবাদকে উসকে দেওয়া হয়। নারী পর্দার পেছনে থাকবে এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চায়। মানসম্মত শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক হওয়া তাই জরুরি। এমন প্রশ্নই হয়তো থাকত না যদি আমাদের পুরুষদের মানসিকতা উদার হতো। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে শুনে ভালো লাগল। তবে সরকারকে গাইড বই প্রকাশের বিষয়টি আরও শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এটা আমার দাবি, প্রত্যাশা।’
এমন প্রত্যাশা আমাদেরও। যে সময়ে আমরা চলছি, নারী-পুরুষের কাজের মধ্যে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। এতে সমাজ এগিয়ে না গিয়ে কয়েক স্তর পিছিয়ে যায়। এই মানসিকতা কবে বদলাবে সমাজের?