কোথাও নারীর মুক্তি নেই
নারীরা পুরুষের হাতে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে আর্থিক নির্যাতন অন্যতম। এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ।

প্রথম আলো: নারী নির্যাতনের চিত্র অনেক রকম। কখনো শারীরিক, কখনো মানসিক, আবার কখনো বা আর্থিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। এই বাস্তবতায় নারীরা কেন আর্থিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন?
এম এম আকাশ: এটা আসলে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার আরেকটি কৌশল। পরিবারের ভেতরে নারী যদি উপার্জনকারী না হন, তাহলে তাঁর হাতে অনেক সময় কোনো টাকাই দেওয়া হয় না বা দিলেও তা হয় যৎসামান্য। পারিবারিক আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে প্রায়ই তাঁর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না। আবার এমনও দেখা গেছে, নিজে উপার্জন করলেও নারী তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করতে পারেন না। কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে নিজের বা স্বামীর টাকা দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হন, তাহলে সেটা শুধু মন-কষাকষিতে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রায়ই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে পরিণত হয়। এটা পিতৃতান্ত্রিক প্রভুত্বের সত্যটাকে উদ্ঘাটন করে দিয়েছে।
প্রথম আলো: অর্থনৈতিক নির্যাতনের ফলে নারীরা কি সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না?
এম এম আকাশ: অবশ্যই নারীরা সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। স্বামী যে পরিমাণ অর্থ দেন, তাতে চাহিদা পূরণ না হওয়ায় অনেকে ধার করেন। সময়মতো সেই ধারের অর্থ ফেরত না দিতে পারলে তাঁরা পাওনাদারদের কাছে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন। অনেক নারী আবার এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যখন পরিবারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে সমাজে বা বাইরের অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তখন দেখা যায় সেখানেও নারী পুরুষের তুলনায় কম মজুরি, কম সুযোগ-সুবিধা, কম স্বীকৃতি, কম মর্যাদা পান। পরিবারের চার দেয়ালের জেলখানা থেকে বের হয়ে একধরনের মুক্তির আস্বাদ নারী পান ঠিকই, কিন্তু তাঁর সার্বিক মুক্তি হয় না। আমরা দেখতে পাই সেই ‘মাকে’, যিনি কর্মক্ষেত্রে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ঘরে ফিরে আবার সংসারের ঘানি টানতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরুষের শ্রমবিভাজনের খাতায় বাড়ির কাজের জন্য কোনো ‘কলাম’ নেই, কিন্তু নারীদের শ্রমবিভাজনের খাতায় ‘বাড়ির কাজ’ ও ‘কর্মক্ষেত্রের কাজ’ দুটি ‘কলামই’ রয়েছে। কোথাও তাই সহজে নারীর কোনো মুক্তি নেই।
প্রথম আলো: বলা হয়ে থাকে, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর মুক্তি ঘটবে, সেই দিক থেকে আর্থিক নির্যাতন নারীর ক্ষমতায়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে কি না।
এম এম আকাশ: অবশ্যই বাধাগ্রস্ত করছে। সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অর্থের প্রয়োজন। অর্থনৈতিক নির্যাতন নারীর ক্ষমতায়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক সময় দেখা যায়, নারী নিজে উপার্জন করেও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন না। উপার্জন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাঁর কাছ থেকে। প্রায় সময়ই এটা ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে সমাজের কাছে অজানা থেকে যায়। নির্যাতিতা নিজেও তা প্রকাশ করতে ভয় পান বা দ্বিধা করেন। যত দিন পুরুষের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন না হচ্ছে এবং সুষম শ্রমবিভাজন না হচ্ছে, তত দিন এ সমস্যা থেকে যাবে। কিন্তু আবার সংসার ভেঙেও এ সমস্যার সমাধান হবে না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই অবস্থাকে ‘সহযোগিতামূলক দ্বন্দ্বের’ সমস্যা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’—এ রকম সমাধানের প্রয়োজন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুচিত্রা সরকার