ক্লাকাঁর জন্য ভালোবাসা অমলিন

১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আসা ফরাসি চিকিৎসকেরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ স্বেচ্ছায় থাকতে চাচ্ছেন না। তখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এলেন পিয়ের ক্লাকাঁ। তিনি ফরাসি জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ। তিনি এলেন বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। সেখানে ফরাসিদের গড়া বাম (ব্রাদার টু অল মেন) হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন।

ক্লাকাঁ এক বছর ছিলেন সারিয়াকান্দিতে। এ সময়ের মধ্যেই তিনি সেখানকার মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তখন তিনি কিছু মানুষের ছবি তুলেছিলেন। ৩০ বছর পর তিনি আবার আসেন। তাঁদের ছবি তোলেন। যদিও সবাইকে পাওয়া যায়নি। ১২ বার বাসস্থান পরিবর্তনের কারণে তিনি অনেক ছবি হারিয়েও ফেলেন। আগে-পরের ছবি দিয়ে ২০০২ সালে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনী করেন, যার শিরোনাম ছিল, 'সারিয়াকান্দির পরিবর্তিত পটভূমি ১৯৭২-২০০২'।

বাংলাদেশে গুটিবসন্ত ও পোলিও নির্মূল, মাতৃ-শিশুস্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে পিয়ের ক্লাকাঁর অবদান রয়েছে। এ কাজে ১০ বছরের বেশি সময় তিনি বাংলাদেশে কাটিয়েছেন। কথা বলতে শিখেছিলেন বাংলায়। বাংলাদেশের এই বন্ধু গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে মারা যান। গত ১৭ এপ্রিল গিয়েছিলাম সারিয়াকান্দিতে। পেয়েছি ছবির অনেক মানুষকেই। ক্লাকাঁর মৃত্যুর খবর শুনে তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেন।

বিস্ময়ের ব্যাপার, এক নামেই সারিয়াকান্দি পৌর এলাকার অনেক মানুষ তাঁকে এখনো চেনেন। স্থানীয়রা পিয়ের ক্লাকাঁকে 'ক্যালাকুইন' নামে ডাকেন। সারিয়াকান্দিতে ঘোরার সময় আমার হাতে ছিল ক্লাকাঁর প্রদর্শনীর ছবিসংবলিত ব্রশিওর। একদল মানুষ সেটা হাতে নিয়ে আগ্রহভরে দেখতে থাকেন।

ক্লাকার ক্যামেরায় কিশোরী ও ৪০ বছর বয়সে আলেয়া বেগম

১৯৭২ সালে ২৫ শয্যার যে 'বাম' হাসপাতাল ফরাসিরা প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেটি এখন সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সারিয়াকান্দি পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাকী মো. জাকিউল আলম বললেন, 'হুবহু ওই হাসপাতালই আছে। শুধু মাঝখানের একটা অংশ কেটে পেছনে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পেছনের দিকে হাসপাতাল সম্প্রসারণ করা হয়েছে।'

ব্রশিওরের প্রচ্ছদে বাঙ্গালী নদীর ৩০ বছর আগের ও পরের ছবি রয়েছে। নতুন ছবিতে নদীর ওপরে সেতু। সারিয়াকান্দি পৌর সদরে ঢুকতেই বাঙ্গালী নদীর সেই সেতু পার হতে হলো। সেতুর ওপরে উঠেই চোখ পড়ল পিয়ের ক্লাকাঁর ৫০ বছর আগের তোলা ছবির দিকে। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে নদীর খেয়াঘাট। খেয়ানৌকা ঘাটে ভিড়ছে। নদীর ঘাটের মালামাল নিয়ে গরুর গাড়ি, ঘাটের লোকজন। সেই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি।

ব্রশিওরের প্রচ্ছদ পাতার একেবারে মাথায় এক কিশোরীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি ও ৩০ বছর পরের পরিণত বয়সের একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এই নারীর নাম আলেয়া বেগম। ২০০২ সালে তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। প্রদর্শনীর সময় প্রত্যেকের ছবির পাশে ৩০ বছরের ব্যবধানে তাদের জীবনের আনন্দ ও দুঃখের স্মৃতি ছাপা হয়েছিল। আলেয়া বেগম বলেছিলেন, তাঁর ছেলে ও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এটাই তাঁর আনন্দের স্মৃতি। আর দুঃখের স্মৃতি ছিল তাঁর বাবাকে হারানো। এরপর বিয়ে হয়েছিল সতিনের ঘরে।

আলেয়া বেগম এখন

সেই আলেয়া বেগম বেঁচে আছেন। বাঙ্গালী নদীর ধারে তাঁর বাড়ি। বাড়ির কাছে গিয়ে জানা গেল, তিনি বাড়িতে নেই, মেয়ের বাড়িতে গেছেন। সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরে তাঁর মেয়ের বাড়ি। মেয়েজামাই একজন ব্যবসায়ী। জামাইবাড়ি গিয়ে পাওয়া গেল আলেয়া বেগমকে। প্রথম দেখায় ছবির কিশোরীর সঙ্গে মেলানো গেল না। সঙ্গে শিক্ষক জাকিউল আলম ছিলেন। তাঁকে দেখেই তিনি হেসে উঠলেন। হাসিতেই ধরা পড়লেন সেই আলেয়া। তাঁর ব্যবসায়ী জামাইয়ের আলিশান বাড়ি। মেয়ে ভালো আছে এটাই তাঁর এখন আনন্দ। তবে ছেলেটা ভালো কোনো কাজে লাগেনি। দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী মারা গেছেন।

ক্লাকাঁর কথা তাঁর ভালো মনে আছে। প্রথম ছবিটা দেখে বললেন, তিনি খেলছিলেন, সে সময় ছবিটা তুলেছিলেন।

ব্যবসায়ী চঞ্চল সাহা ও তাঁর ভাই ভক্ত সাহাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। আগে টিনের ঘর ছিল এখন দোতলা পাকা বাড়ি হয়েছে। চঞ্চল সাহার প্রথম ছবিটি ১৫ বছর বয়সের। পূজার অনুষ্ঠানে ছিলেন। ৩০ বছর পরের ছবিটি তাঁর ভাই ও বাবার সঙ্গে তোলা। চঞ্চল সাহার দুই ছেলে চয়ন সাহা ও অয়ন সাহা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভক্ত সাহার ছেলে লিখন সাহা এখন সারিয়াকান্দি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক।

১৯৭২ সালে ২০ বছর বয়সী ভক্ত সাহা একটি পূজার নৌকার ওপরে ছিলেন। ক্লাকাঁ সেই ছবি তুলেছিলেন। এখন বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছাড়া ভক্ত সাহার কোনো সমস্যা নেই। ভক্ত সাহা বললেন, এলাকাটি আমূল পাল্টে গেছে। তবে তখনকার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো হয়নি। সেই সময় (ক্লাকা যখন ছিলেন) এই অজপাড়াগাঁয়ে অত্যাধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জটিল রোগীদের হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হতো। দিনাজপুর থেকে রোগী সারিয়াকান্দিতে আসত।

ভক্ত সাহা বললেন, 'ক্লাকাঁ খুব সহজ মানুষ ছিলেন। আমাদের বাড়ির আঙিনায় একটি জাম্বুরাগাছ ছিল। বিকেলে সেই গাছের নিচে আমার মায়ের কাছে এসে বসে গল্প করতেন। খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁকে সারিয়াকান্দির মানুষও খুব ভালোবাসত। কোনো দোকানে কিছু কিনতে গেলে তাঁর কাছ থেকে দাম কম নিত সবাই।'

পাতারু মাঝি বাঙ্গালী নদীতে নৌকা বাইতেন। ১৯৭২ সালে তাঁর নৌকার ওপরে কিশোর পাতারুর ছবি আছে। ২০০২ সালে তাঁর বয়স ছিল ৪৫ বছর। এখন বাঙ্গালী নদীর সেতুর মুখেই তাঁর বাড়ি।

পাতারুর মন ভালো নেই। সেতু হওয়ার পরে খেয়ার কাজ নেই। এখন জেলেদের সঙ্গে নদীতে জাল দড়ি টানেন। বড় দুই ছেলে মানসিক রোগাক্রান্ত। ছোট ছেলেটা বাবার মতোই অন্যের জাল–দড়ি টানে। তবে সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, তাঁর বাড়ির জায়গাটা সরকার অধিগ্রহণ করেছে। বিনিময়ে পেয়েছেন সামান্য কিছু টাকা। এখন যেকোনো দিন এই জায়গা ছাড়তে হবে। ক্লাকাঁ নেই শুনে পাতারুর স্ত্রী যমুনা রানী চোখ মুছলেন। দুঃখ করে বললেন, তখন ক্যালাকুইন তাঁর দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য কত সেধেছিলেন। বগুড়ায় নিয়ে গিয়ে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ালেন। দই খাওয়ালেন কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি। তাঁরা যাননি। এখন তো আর যাওয়ার কোনো জায়গাই নেই।

ব্রশিওরে ২০০২ সালের প্রদর্শনী সম্পর্কে ক্লাকাঁ লিখেছিলেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে সারা দেশে নিজেকে জানার সচেতনতা তৈরিতে সারিয়াকান্দি পথিকৃৎ হয়ে থাকবে।