খালাতো মামাতো ভাইবোনের বিয়ে!

চোখের সামনে দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেল। ফুফাতো ভাইয়ের মেয়ের দিকে তাকিয়ে একদিন ভাবলেন রাজিয়া বেগম। ফুটফুটে মেয়েটা, মুখে হাসি লেগেই আছে। পরিবারে সবাই মেয়েটাকে ভালোবাসে। হাতের কাছে এমন চমৎকার একটা মেয়ে থাকতে নিজের প্রকৌশলী ছেলের জন্য আর বউ খোঁজাখুঁজির দরকার কী? দোনোমোনা করতে করতে একদিন কথাটা পেড়েই ফেললেন ভাইয়ের কাছে। ভাই-ভাবিও খুশিতে আটখানা। তারপর ধুমধাম করে হয়ে গেল বিয়ে, প্রিয় ভাইঝিকে বউ করে বাড়িতে নিয়ে এলেন রাজিয়া বেগম। ‘একমাত্র ছেলের বউ, বউ কোথায়-ও তো আমার মেয়েই। এখনো ছোটবেলার মতোই আবদার করে, খুনসুটি করে। জানি না, অন্য পরিবারের মেয়ে হলে এতটা আন্তরিক হতো কি না।’ বলেন তিনি।
মুদ্রার অপর পিঠও আছে। ছোটবেলার খেলার সাথি মামাতো বোন তানিয়াকে (ছদ্মনাম) বড় হওয়ার পর নতুনভাবে একদিন আবিষ্কার করে রোমেল (ছদ্মনাম)। কবে যে খেলতে খেলতে ভালো লাগা, তারপর প্রেমে পড়া-কেউ কিছু বুঝতেই পারেনি। তানিয়াও এতকালের জানাশোনা রোমেলকে দেখে আজকাল লজ্জায় লাল হয়, ও বাড়ি যাবার কথা শুনলে মন উড়ু উড়ু করে। তারপর দুজনে একদিন মনের আগল ভেঙে ভালো লাগার কথা প্রকাশই করে ফেলে। পরিবারে বিষয়টা জানাজানি হতেই শুরু হয়ে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। রোমেলের মা প্রথমেই বেঁকে বসলেন, ‘এ হতেই পারে না। ভাইয়ের বউয়ের চাল এটা।’
তানিয়ার মাও শুনিয়ে দিলেন, বয়েই গেছে এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে! পরিবারের অন্যরা এই দুই পক্ষেÿ বিভাজিত হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত অনেক গোলমাল ও বিবাদের পর বড় মামা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দুজনের বিয়ে দেন, সবাইকে ঠান্ডা করে। তাতে যে পরিবেশ খুব ঠান্ডা হয় তা নয়। তানিয়া শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই বুঝতে পারে সে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রিয় ফুফু যেন এখন তাকে সহ্যই করতে পারছেন না। আবার তানিয়াদের বাড়িতেও রোমেল যে খুব সদাচরণ পায় তা নয়। তানিয়া-রোমেলের এই সংসার টিকেছিল দুই বছর, নানা ঝামেলায় নিজেদের মধ্যেও প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি লেগে যেত ওদের। প্রায়ই তানিয়া চলে আসত বাপের বাড়ি। এভাবে চলতে চলতে এক দিন বিয়েটাই গেল ভেঙে।
মাহফুজ উল্লাহ ও জেসমিন জাহান খালাতো ভাইবোন। মেলামেশার সুযোগ ছিল। মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ভালো লাগার পাশাপাশি একপর্যায়ে আমরা দেখলাম বোঝাপড়াটাও ভালো। পরিবারের সবাই সম্মত ছিলেন না। আমরা নিজেদের চাওয়াকেই গুরুত্ব দিলাম। একপর্যায়ে সবাই বুঝল আমরা কোনো ভুল করিনি, সবই ঠিক হয়ে গেল। সন্তান-সংসার নিয়ে বেশ আছি। সামাজিক জীবনও চমত্কার।
রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে—সহজ কথায় যাকে বলে কাজিন ম্যারেজ, বাংলাদেশে খুব একটা বিরল ব্যাপার নয়। কিছু কিছু এলাকায় তো এটা রীতিমতো একটা সংস্কৃতি। কেবল বাংলাদেশে কেন, গবেষকেরা বলছেন মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের সংখ্যা মোট বিবাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এমনকি এই প্রবণতা দক্ষিণ ভারতেও দেখা যায়। যদিও হিন্দু সংস্কৃতিতে রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়র সঙ্গে বিয়েতে বিধিনিষেধ রয়েছে। পরিবারের সম্পদের সুষম বণ্টন, মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মেয়েকে কাছাকাছি কিংবা একই গোত্রে, গ্রামে রাখতে পারার মতো বিষয়গুলো এ ধরনের বিয়েতে আগ্রহের প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকেরা। কিন্তু এই ‘কাজিন ম্যারেজ’ ভালো নাকি মন্দ তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্য রক্ত সম্পর্কের বিবাহকে বেশি উৎসাহ দিতে রাজি নয়। বলা হয় ফার্স্ট কাজিনদের (সরাসরি খালাতো, মামাতো, চাচাতো বা ফুফাতো ভাইবোন) জিনগত মিল প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ, অর্থাৎ তারা বংশপরম্পরায় অনেক জিন একইভাবে বহন করে চলেছেন। এ কারণে যেসব রোগবালাই তাদের বংশে রয়েছে, সেসব তাদের সন্তানদের মধ্যে আরও প্রকটভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে অটোসোমাল রিসেসিভ কিছু রোগ (যেমন, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস) পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তীব্রতর হয়ে দেখা দিতে পারে। নিজ বংশ এবং নিজ গোত্রে বিবাহরীতির কারণে থ্যালাসেমিয়া ও জিনগত রক্তরোগ মধ্যপ্রাচ্যে একসময় এত প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে আরব সরকার বিয়ের আগে বর-কনের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেয়। এ ছাড়া গবেষণা বলছে পরস্পরের আত্মীয় স্বামী-স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে জন্মগত জটিলতা, ডাউনস সিনড্রোম, গর্ভপাত বা নবজাতক মৃত্যুর হার অন্যদের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি।
অপরদিকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বিয়ে নিয়ে নানা মতবাদ প্রচলিত। কেউ বলেন একই পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা আত্মীয় দুটি ছেলেমেয়ের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো হবে এবং মানিয়ে নেওয়াটাও সহজ হবে। অনেক পরিবারে বা গোত্রে মনে করা হয় এতে করে পরিবারের সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবারের মধ্যেই থাকবে। তবে একই পরিবারে বিয়েতে ভুল-বোঝাবুঝি, মনোমালিন্য যে হয় না তা নয়। এতে ঝামেলাটাও হয় বেশি।
মোট কথা, কোনটা ভালো হবে বা কোনটা মন্দ-তা আগে থেকে ধারণা করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবারের মধ্যে বিয়ে ঠিক করার আগে এই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জন্মগত ক্রটি, কম বয়সে দৃষ্টি ও শ্রবণ সমস্যা, জিনগত রক্তরোগ, খিঁচুনি ইত্যাদি রোগের প্রকোপ আছে কি না দেখে নেওয়া উচিত। অনেক দেশে কাজিন ম্যারেজের আগে বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিং ও স্ক্রিনিংয়েরও ব্যবস্থা আছে।