খেলায় দেশসেরা নড়াইলের যে বিদ্যালয়

নড়াইলের লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ৬১ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বর্তমানে খেলোয়াড় হিসেবে চাকরি করছেন সশস্ত্র বাহিনীতে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা হকি দলের অধিনায়ক রিতু খানমের হাতেখড়ি এখানেই। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ে শীতকালীন অ্যাথলেটিকসে টানা ১২ বার দেশসেরা হয়েছে। এবারও জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় পেয়েছে ১০টি স্বর্ণপদক। ক্রীড়ায় এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সাফল্যের সূত্র এই প্রতিবেদনে।

নড়াইলের লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে এমন দৃশ্য রোজকার
ছবি: ছুটির দিনে

সকাল সাতটা। আটপৌরে শহর আড়মোড়া ভেঙে জাগছে মাত্র। তবে পৌর বাজারের মাঝখানের চিত্রটা ভিন্ন। এখানেই নড়াইলের লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীরের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় মনে হলো, কত বেলা যেন হয়েছে! ভেতরে কোলাহল। ভেসে আসছে হাঁকডাক। শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড়ে প্রাণবন্ত এক পরিবেশ।

২ নভেম্বর মূল ফটক পেরিয়ে বিদ্যালয়ের ভেতরে যাই। মাঠে তখন একদল শিক্ষার্থী। শারীরিক কসরতে মগ্ন। অর্ধেকের বেশি ছাত্রী। শরীরচর্চা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নানাভাবে কসরত করাচ্ছেন। একেক দল একেক অনুশীলনে মেতে আছে। কেউ হ্যান্ডবল, কেউ ফুটবল, কারও হাতে হকিস্টিক। সাতসকালে ক্রীড়ামোদী শিক্ষার্থীদের এই উপস্থিতিই মনে করিয়ে দিল ক্রীড়াক্ষেত্রে বিদ্যালয়টির সাফল্যের কারণ।

এক ফাঁকে আলাপ জমাই দিলীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বিদ্যালয়টির খণ্ডকালীন ক্রীড়াশিক্ষক। তাঁর কাছে শুনতে চাই লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কীভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশসেরা হলো। সে কথা খোলাসা না করে, তিনি ডাকলেন এক ছাত্রীকে! তার নাম সামিয়া খানম।

সামিয়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এবার সে জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে। সাত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে রোজ সকালে হাজির হয় অনুশীলনে। সামিয়া বলছিল, ‘প্রতিদিন যানবাহনে যাতায়াত করার আর্থিক সংগতি নেই আমার পরিবারের। বাইসাইকেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন স্কুলের দুজন শিক্ষক।’ এখন সামিয়া স্বপ্ন দেখে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরতে।

লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ক্রীড়াক্ষেত্রে কীভাবে সফল হচ্ছে, তার হয়তো নমুনা পাওয়া গেল সামিয়ার গল্পে।

সকাল–বিকেল অনুশীলন চলে বিদ্যালয়ের মাঠে

খেলায় সেরা

ক্রীড়াক্ষেত্রে লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য আছে। ১৯২০ সালে লোহাগড়া ফুটবল দল গঠিত হয়। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র কাশিনাথ সরকার। ১৯৩৬ সালে নড়াইলের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আন্তবিদ্যালয় ক্রীড়া চালু করেন। গঠিত হয় আন্তবিদ্যালয় ক্রীড়া সমিতি। তার সম্পাদক হন স্কুলটির তৎকালীন প্রধান শিক্ষক। এর পর থেকে খেলায় এগোতে থাকে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তবে নতুন মাত্রা পায় ২০০২ সালের পর, দিলীপ চক্রবর্তীর হাত ধরে

দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে সবচেয়ে বড় আসর শীতকালীন জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সেখানে অ্যাথলেটিকসে টানা ১২ বার দেশসেরা হয়েছে বিদ্যালয়টি। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর এ প্রতিযোগিতা বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে এ প্রতিযোগিতায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২৯টি পদক পেয়েছে। এর মধ্যে ১২টি সোনা। এর আগের বছর পেয়েছে ১৪টি স্বর্ণপদক। এভাবে গত ১২ বছর ধরে দেশের মধ্যে একক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সোনার পদক পেয়েছে বিদ্যালয়টি।

এ ছাড়া জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ২০০৫ সাল থেকে স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ বছর ২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে এ বিদ্যালয় স্বর্ণপদক পেয়েছে ১০টি। এ প্রতিযোগিতায় ২০১৬ সালে দীর্ঘ লাফে সাদিয়া খানম ৫ দশমিক ২১ মিটার অতিক্রম করে স্বর্ণপদক পায়। এ রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। ২০১৮ সালে বিজয় মল্লিক ৪ দশমিক ১৯ সেকেন্ডে ১৫০০ মিটার দৌড়ায়। এ রেকর্ডও ভাঙতে পারেনি কেউ। ১০০, ২০০, ৪০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়, রিলে দৌড়, দীর্ঘ ও উচ্চ লাফ এবং গোলক, বর্শা ও চাকতি নিক্ষেপসহ প্রায় সব বিভাগে উল্লেখ করার মতো অর্জন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এসব পরিসংখ্যান শোনাতে শোনাতে গর্বে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দিলীপ চক্রবর্তীর।

রিতুদের হাতেখড়ি

লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে পুরুষ ও নারী হকি দল রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ নারী হকি দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে এ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাদিয়া খানম, নমিতা কর্মকর ও রিতু খানমও আছেন। রিতু খানম জাতীয় হকি দলের অধিনায়ক। আন্তজেলা নারী হকি টুর্নামেন্টে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে নড়াইল জেলা হকি দল দেশে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ২০২০ সালে হয়েছে রানার্সআপ। নড়াইল জেলা দলের সব খেলোয়াড় এই বিদ্যালয়ের। ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গেমসে নড়াইল জেলা নারী হকি দল চ্যাম্পিয়ন হয়। সে দলের ১৬ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ৮ জনই লোহাগড়ার এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

নারী ও পুরুষ হ্যান্ডবল দলও সেরা হয়েছে নানা ক্ষেত্রে। আন্তজেলা নারী হ্যান্ডবল লীগে নড়াইল জেলা দল ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দলটির ১২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ৮ জনই এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় হ্যান্ডবল দলের খেলোয়াড় মোহাম্মদ আলী হোসেন এ বিদ্যালয়ের। ফুটবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেটেও ছেলে ও মেয়েদের চর্চা শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে। এগুলোতেও সাফল্য এসেছে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে। বিদ্যালয়টির ৬১ জন শিক্ষার্থী বর্তমানে খেলোয়াড় হিসেবে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করছেন। যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি।

দিলীপ চক্রবর্তী গর্ব করে বলছিলেন, ‘মেয়েরা নির্দেশনা মানে বেশি, তাই তারা বেশি এগিয়ে।’

সাফল্য ধরে রাখতে চান

রোজ দুবার লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে অনুশীলন হয়। সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত। বিকেলের অনুশীলন চলে ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত। কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থাকলে তার আগে নিবিড় অনুশীলনও করান দিলীপ চক্রবর্তী। এই ক্রীড়াশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে হাজির হয়েছিলাম বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এস এম হায়াতুজ্জামানের দপ্তরে। তিনি বলছিলেন ক্রীড়াক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্যের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা—‘আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের বাছাই করি। ক্রীড়ায় সাফল্যের শীর্ষে গেছে যারা, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। স্কুল থেকে তাদের বেতন নেওয়া হয় না। দিলীপ চক্রবর্তী খেলার প্রশিক্ষণও দেন বিনা মূল্যে।’

কান্ডারির নাম দিলীপ চক্রবর্তী

দিলীপ চক্রবর্তী তখন লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তাঁর ক্রীড়াশিক্ষক শক্তিপদ সরকার তাঁকে একদিন ডাকলেন। অ্যাথলেট হিসেবে দিলীপের প্রশংসা করলেন। শিক্ষকের হাত ধরে অংশ নিতে থাকলেন ফুটবল ও অ্যাথলেটিকসে। ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে শীতকালীন অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় এ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেন দিলীপ। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। উপলব্ধি করলেন, এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ।

ব্যর্থ হলেও দিলীপ চক্রবর্তী খেলার মাঠ ছাড়েননি। নড়াইল জেলা দলের ফুটবল খেলোয়াড় হন পরে। আরও পরে বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নেন। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের খেলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। সাফল্য পেতে থাকেন।

২০০২ সালের কথা। দিলীপ চক্রবর্তীর শিক্ষক শক্তিপদ সরকার আমন্ত্রণ জানা ছাত্রকে। রাজি হয়ে যান দিলীপ। শুরু করেন নিবিড় প্রশিক্ষণ। সে বছরই জাতীয় শীতকালীন অ্যাথলেটিকসে সোনা জেতেন বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে স্বর্ণপদক আসে চারটি। পরের বছর দিলীপকে খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর বিদ্যালয়ের সাফল্যের ঝুড়ি ক্রমান্বয়ে ভরতে থাকে। দিলীপ খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবেই আছেন। এইচএসসি পাস দিলীপ, তাই স্থায়ী চাকরি হওয়ার সুযোগ নেই।

দিলীপ চক্রবর্তী

এ নিয়ে মনঃকষ্টও নেই দিলীপের। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে সকাল সাতটার মধ্যে মাঠে হাজির। চলে নয়টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ। এরপর বাসায় এসে নাশতা করেন। সকাল ১০টার মধ্যে স্কুলে গিয়ে অ্যাসেম্বলিতে অংশ নেন। দুপুরে বাড়ি ফেরেন। কিছুক্ষণ বিশ্রামে থেকে বিকেল চারটা থেকে আবার মাঠে। এরপর রাত আটটা পর্যন্ত থাকেন স্কুলে। তিনি বলেন, ‘এটাই আমার জগৎ। এখানেই শান্তি। এর বাইরে শান্তি কোথাও পাই না। তবে দুঃখবোধ কাজ করে এক জায়গায়। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এরা। প্রশিক্ষণের সময়ে নাশতা দিতে পারি না।’

দিলীপ চক্রবর্তী নিজেও পেয়েছেন স্বীকৃতি। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন ২০১৮ সালে সেরা সংগঠকের পুরস্কার দিয়েছে। আরটিভি দিয়েছে অ্যাথলেট ও খেলোয়াড় তৈরির কারিগর প্রেরণা পদক। নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন দিয়েছে বিশেষ ক্রীড়া সম্মাননা। উপজেলা স্কাউটসের কোষাধ্যক্ষ, টানা ১৭ বছর ধরে। ফুটবল রেফারি হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় অংশ নেন।

দিলীপ চক্রবর্তী বললেন, ‘সাফল্যের মূল মন্ত্র নিবিড় প্রশিক্ষণ। জাতীয় রেকর্ড, সাফ গেমসের রেকর্ড সামনে আনি। সেই রেকর্ড ভাঙার চর্চা করা হয়। আন্তর্জাতিক সব রেকর্ড ভাঙার মিশন নিয়ে হয় প্রতিদিনের চর্চা। এভাবেই দিন দিন বাড়ছে সাফল্য। স্বপ্ন দেখি, আন্তর্জাতিক সব আসরে আমার ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল নক্ষত্র হবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।’