গরিব মানুষেরা কীভাবে বাঁচে?

ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরের বাসিন্দা জরিনা খালা ও তাঁর মেয়ে মালি। ছবি: শিহাব উদ্দিন
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরের বাসিন্দা জরিনা খালা ও তাঁর মেয়ে মালি। ছবি: শিহাব উদ্দিন

কী ঘটল, যখন অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও আলোকচিত্রী শিহাব উদ্দিন মিশে গেলেন বাংলাদেশের হতদরিদ্র তিন পরিবারের সঙ্গে? আর কীভাবেই বা তিনি ফ্রেমে বন্দী করলেন তাদের যাপিত জীবন? জানাচ্ছেন জাহীদ রেজা নূর
মালির মুখের এই হাসি শিহাব ভুলবেন না কোনো দিন।
সবে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন থেকে ঢাকায় এসেছেন শিহাব। বহুদিন জরিনা খালার পরিবারের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই। এসে শুনলেন, জরিনা খালার একমাত্র মেয়ে মালি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। শিহাব গেলেন দেখা করতে। ওকে দেখেই মালির হাসি ছড়িয়ে পড়ল কান পর্যন্ত! যেন অতি আপন একজনকে বহুদিন পর কাছে পেয়েছে।
এটুকু শুনে সংশয়ী কেউ বলতেই পারেন, এ আর এমন কি! কাছের মানুষ ফিরে এলে স্বজনের তো আনন্দ হবেই!
সংশয় কাটানোর জন্য বলি, শিহাবের সঙ্গে জরিনা খালা বা মালির রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। সমাজের একই স্তরে তাদের বসবাসও নয়। মালিকে নিয়ে জরিনা খালা কমলাপুর রেলস্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরের রাস্তায় রাতে ঘুমান। একটি চাদর বিছিয়ে মশারি টানিয়ে মা-মেয়ের অস্থায়ী আবাস গড়ে উঠেছে ফুটপাতেই। আর হ্যাঁ, মালি নামে যে কিশোরী মেয়েটির কথা বলা হলো, সে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। জরিনা খালা ভাঙারির কাজে গেলে মালিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে যেতে হয়।
শিহাবের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক কীভাবে হলো, তা জানার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে।

সপরিবারে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের নূরজাহান খালা
সপরিবারে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের নূরজাহান খালা


একটি ডিম
খুলনার দাকোপের বেল্লাল ভাই একদিন তাঁর বাড়িতে শিহাবকে খেতে বললেন। এত দিনে শিহাবের জানা হয়ে গেছে বেল্লাল ভাইয়ের পরিবারটি চলে কায়ক্লেশে। সমুদ্রে চিংড়ির পোনা ধরেই চলে তাঁর সংসার। কখনো কাঠ কাটেন। সারা বছর সাকল্যে এক বা দুই কেজি মাংস, একটি-দুটি মাছ জোটে কপালে। বাকি পুরোটা সময় কোনো দিন খাবার জোটে, কোনো দিন জোটে না। এক থালা ভাত আর কোনো এক সবজি তাঁদের কাছে মহার্ঘ্য খাদ্য! সেই পরিবারের দাওয়াতে গিয়ে শিহাব দেখেন ভাতের সঙ্গে টেবিলে একটি পাত্রে একটা ডিম!
শিহাব প্রমাদ গোনেন। বুঝতে পারেন, বাঙালির অতিথি আপ্যায়নের চিরাচরিত পথটিই বেছে নিয়েছেন বেল্লাল ভাই।
শিহাব বললেন, ‘একটা আস্ত ডিম আমি খেতে পারব না।’
বেল্লাল ভাই বিচলিত হয়ে বললেন, ‘আপনার জন্যই তো রান্না হলো!’
শিহাব বললেন, ‘না। এই ডিমটা আমি আর বিলকিস (বেল্লাল ভাই আর নূরুন্নাহার ভাবির মেয়ে) ভাগ করে খাব!’
বিলকিসের ভাগ্যে সেদিন ‘রাজ খাবার’ জুটেছিল। বহুদিন পর ডিমের স্বাদ পেয়েছিল সে।

আর আমাদের শিহাবের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল অশ্রু—তা আনন্দাশ্রু, নাকি বেদনায় মোড়া, তার উত্তর শিহাব এখনো জানে না।

খুলনার দাকোপের বেল্লাল ভাই ও তাঁর পরিবার  ছবি: শিহাব উদ্দিন
খুলনার দাকোপের বেল্লাল ভাই ও তাঁর পরিবার ছবি: শিহাব উদ্দিন

নূরজাহান খালা
বাড়ির কর্তা আবুল হোসেনের মতো খেয়ালি মানুষ খুব কম আছে। রোজগার তাঁরই করার কথা। কিন্তু কী এক রহস্যময় কারণে ভবঘুরে জীবনকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। ফলে স্ত্রী নূরজাহানকেই টানতে হচ্ছে সংসারের ঘানি। পরিবারের সদস্যসংখ্যা সাত, বাস করেন ৭ ফুট বাই ১০ ফুট একটি ঘরে।
শিহাব এই পরিবারে এসে দেখেছেন, কীভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। ছেলেমেয়েরা রোজগার করছে। তা দিয়েই কোনোভাবে চলছে সংসার। তিনটি পরিবারের মধ্যে এই পরিবারেই রয়েছে একটু পরিকল্পিতভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা। এখানে শিহাবকে কম কষ্ট করতে হয়েছে।
এবার আমরা এই তিন পরিবারের সঙ্গে শিহাবের সম্পর্ক গড়ে ওঠার গল্পটি বলতে পারি।
দারিদ্র্যের সরলীকরণ

খুলনার দাকোপের সেই ব্যতিক্রমী আলোকচিত্র প্রদর্শনী
খুলনার দাকোপের সেই ব্যতিক্রমী আলোকচিত্র প্রদর্শনী


শিহাব উদ্দিন মাস্টার্স অব ভিজ্যুয়াল আর্ট ডিগ্রির জন্য অস্ট্রেলিয়ায় যান ২০১২ সালে। কুইন্সল্যান্ড কলেজ অব আর্ট, গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য বিষয়টি নিয়ে সুপারভাইজার ডেভিড লয়েড আর জর্জ প্যাটলিনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তাঁরা সমর্থন দেন। বিষয়টিকে শিহাব ভেবেছেন এভাবে: ‘আমরা যখন কোনো দরিদ্র মানুষের ছবি তুলি, তখন কিন্তু “একজন মা”, “একজন দরিদ্র নারী”—এ ধরনের কথা বলে তাঁকে সরলীকরণ করে ফেলি। এই মানুষদের প্রত্যেকের জীবনে যে আলাদা গল্প আছে, তাঁদের জীবন যে বহুমাত্রিক—তা নিয়ে আমরা ভাবি না।’
এই মানুষদের সঙ্গে মিশে গেলে নতুন চিন্তা বা নতুন গল্পের জন্ম হতে পারে। বাংলাদেশের তিনটি পরিবারের সঙ্গে বছরে অন্তত দুই সপ্তাহ করে থেকে তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়ে করতে হবে এই গবেষণা। শিহাব সেটাই করেছেন। এবং এ বছর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনটি ধারাবাহিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন সেই তিন পরিবারের বসবাসের জায়গাতেই। এই অভিনব ভাবনার উদ্দেশ্য হলো, এই মানুষেরা গ্যালারিতে গিয়ে শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ পান না। তাই গ্যালারিকেই তাঁদের কাছে নিয়ে আসা। দাকোপ ও কমলাপুরে প্রদর্শনীর পর এখন কামরাঙ্গীর চরে শেষ প্রদর্শনী নিয়ে ব্যস্ত শিহাব। ‘দারিদ্র্যের শেকল’ নামে চলছে এই প্রদর্শনী।

মাস্টার্সের থিসিসটিই এখন বড়সড় হয়ে ডক্টরেটের থিসিসে পরিণত হয়েছে।

রোজগারের উপায়
রোজগারের উপায়

রাস্তার জীবন
গবেষণা করতে গিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতার সামনে পড়েন শিহাব। আগে সংবাদপত্র বা বিদেশি জার্নালের জন্য ছবি তুলতে বহুবার কমলাপুর রেলস্টেশনে গেছেন। লো অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন! কিন্তু যেদিন আক্ষরিক অর্থেই প্রথমবারের মতো কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের সামনের রাস্তায় ঘুমানোর জন্য শুলেন, তখন সব দম্ভ, অহমিকা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। সেখানে শুয়ে দেখলেন, পথচলতি মানুষেরা অনেক বড়। তাদের পাগুলো অনেক বড়। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র একজন বলে মনে হলো। তিন বছর দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে শিহাবের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
একটি বিচিত্র পরিবর্তনের কথা বললেন শিহাব। ‘এই তিনটি পরিবারের সঙ্গে জীবন মানিয়ে নিতে গিয়ে লক্ষ করলাম, আমি এখন কিছু কিছু জায়গায় আগের চেয়ে কম আত্মবিশ্বাসী। তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন দেখতে গিয়েই এটা হয়েছে। অন্যদিকে যে পরিবারগুলোর সঙ্গে থেকেছি, তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে।’
গবেষণা করার সময় পরিবার তিনটির অনুমতি নিতে হয়েছিল। এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছিল কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও সাজেদা ফাউন্ডেশন। কিন্তু বস্তির কোনো পরিবার খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হলো। তাঁরা বলেন, ছবি তুলে চলে যান। দিন-রাত থাকবেন কেন? আমি উপলব্ধি করলাম, কথা বলার অধিকার পেলে যেকোনো স্তরের মানুষই ‘না’ বলার অধিকার অর্জন করে। এ ছিল শিহাবের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। ছবি তোলার জন্য কখনো এই শ্রেণির মানুষের কারও কাছ থেকে ‘না’ শুনতে হবে—এটা একেবারেই জানা ছিল না শিহাবের।
একই রকম জীবন যাপন করার ক্ষেত্রে একটি শর্ত ছিল। খাওয়াদাওয়া একসঙ্গে করা হবে না। তবে যেদিন পরিবারগুলো খেতে পেত না, সেদিন শিহাবও তাদের সঙ্গে উপোস করতেন। উপোস থাকার যন্ত্রণা বোঝা সহজ হয়েছে।

একসঙ্গে পথচলা

বহুদিন পর আবার দেখা  হলো শিহাব ও মালির
বহুদিন পর আবার দেখা হলো শিহাব ও মালির


তিন বছরে অন্তত দুই সপ্তাহ পরিবারগুলোর সঙ্গে থাকতে গিয়ে শিহাবের সঙ্গে এদের সম্প্রসারিত পারিবারিক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। এখন ওরা নিজেদের কথা বলার মতো একজন মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। আনন্দ বা দুঃখ কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারে তারা। বেল্লাল ভাইয়ের মেয়ে বিলকিসের নিউমোনিয়া হয়েছে। শিহাবের খুলনার বাসায় এসেছেন তাঁরা। চিকিৎসা করিয়েছেন।
আলোকচিত্রী হিসেবে এই নতুন অভিজ্ঞতাটি শিহাবকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। আগে দরিদ্র মানুষের ছবি তুলে দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠা পাওয়াটাই ছিল মুখ্য। এখন যেন এই মানুষদের অবয়বটাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। মানুষকে ছবি হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই ভাবতে শিখছেন তিনি। এখন শিহাব নিশ্চিত, আলোকচিত্রী হিসেবে সফল হওয়ার চেয়েও একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে স্পর্শ করাটা অনেক বেশি জরুরি।
এখন যা ভাবনা
জরিনা খালা মারা গেলে মালির কী হবে? বেল্লাল ভাই কি বেরিয়ে আসতে পারবেন দারিদ্র্য থেকে? স্বপ্ন পূরণ হবে কি নূরজাহান খালার? মাত্র তো তিনটি পরিবার, কিন্তু ভাবনা সীমাহীন। আর্থিক সাহায্যের চেয়ে পরিবারগুলোর বেশি প্রয়োজন মানসিক ও সামাজিক সাহায্যের। সেটাই সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন শিহাব। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষকে ছবির বিষয় হিসেবে দেখতে দেখতে যখন আবার মানুষ হিসেবে দেখার চোখ লাভ করলেন, তখনই বুঝতে পারলেন, মানুষই ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু, অন্য কিছু নয়।