গানের এমন দরদি কি আর পাব?
>

মাইজভান্ডারি ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের দিকপাল আবদুর গফুর হালী ৮৮ বছর বয়সে মারা যান ২১ ডিসেম্বর। সোনাবন্ধু, দেখে যা রে মাইজভান্ডারে, পাঞ্জাবিওয়ালাসহ অনেক কালজয়ী গানে স্রষ্টা তিনি। তাঁর সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতেন আঞ্চলিক গানের খ্যাতনামা িশল্পী কল্যাণী ঘোষ। গফুর হালীকে দাদা বলে ডাকলেও সম্পর্ক ছিল বাবা-মেয়ের। গত বৃহস্পতিবার নগরের সদরঘাটের বাসায় গফুর হালীকে নিয়ে এই িশল্পী স্মৃতির ঝাঁপি খোলেন। সেই গল্প শুনেছেন আশরাফ উল্লাহ
জীবনের শেষ বেলায়ও সুরের মধ্যে ছিলেন গফুর দাদা। মারা যাওয়ার দুদিন আগে সোমবার সন্ধ্যায় আমার কণ্ঠে গান শুনলেন। তাঁর প্রিয় গানগুলোর তিনটি—‘দেখে যা রে মাইজভান্ডারে’, ‘বাবা দুই কূলের সুলতান’ ও ‘তুমি আমার কাবা শরিফ, তুমি মদিনা’। শেষ দিন পর্যন্ত মাথা ছিল ঠিকঠাক। ‘বাবা দুই কূলের সুলতান’ গানটিতে আমি অন্তরা ভুলে গেলে আমাকে শুধরে দেন। আমি অবাক হয়ে যাই।
অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হওয়ার পর থেকে ছায়ার মতো তাঁর সঙ্গে ছিলাম। হাসপাতালে আমি গেলে তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। গান নিয়ে বিস্তর কথা হতো। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসার পরও প্রায় প্রতিদিন তাঁকে দেখতে যেতাম। শেষ দেখাটা হলো গত মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর)। বিকেলে গফুর দাদাকে ছেড়ে আসার সময় অতি কষ্টে হাত তুললেন। হাসপাতাল থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর মনটা খচখচ করছিল। মনে হচ্ছে শেষ মুহূর্ত চলে এসেছে। ঠিকই ভোরে শুনলাম, তিনি আর নেই। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন।
গফুর দাদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৬ সালে। আমার বয়স তখন ১১। একদিন শ্যাম দাদার (শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব) বাসায় বসে আছি। চলছিল গানের অনুশীলন। সেখানে হঠাৎ হাজির গফুর দাদা। পরিচয়ের পর টুকটাক কথা হলো। প্রথম দেখায় বড্ড আপন মনে হলো লোকটাকে। পরদিন আমার মেহেদীবাগের বাসায় হাজির গফুর দাদা। বললেন, ‘তোর জন্য দুটি গান নিয়ে এসেছি। হারমোনিয়াম নিয়ে আয়। তুই গাইবি।’
এত দিন গফুর দাদার কথা শুনে এসেছি। তিনিই আমার গলায় গান তুলে দেবেন। আমার তো আনন্দ আর বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। আমি সুর তুললাম—‘ন মাতায় ন বুলায় গেলি রে বন্ধুয়া’। গান শেষে বললেন, ‘পরেরটা ধর’। এবার করলাম ‘নিষেধ করি বারে বারে’। উচ্ছ্বসিত গফুর দাদা মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলেন। এভাবে চলতে থাকল গানের তালিম। দিনে দিনে আমি হয়ে গেলাম গফুর দাদার পরিবারেরই একজন।
সেই সূত্রে গফুর দাদার সঙ্গে আমার সম্পর্কের বয়স ৪০ বছর। তাঁকে দাদা ডাকলেও আমার কাছে তিনি ছিলেন পিতৃতুল্য। তিনিও আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। মাথার ওপর ছিলেন বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে। তাঁর চলে যাওয়া বিরাট শূন্যতা তৈরি করে দিয়ে গেছে। মাইজভান্ডারি ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক গানের এমন দরদি কি আর পাব আমরা? তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। প্রায় তিন হাজার গান রয়েছে তাঁর।
মাইজভান্ডার দরবারের বড় ভক্ত ছিলেন। সত্তরের দশকের শেষ দিকে দরবারি গানকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনিই সাহসী পদক্ষেপ নেন। প্রথম আমাকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘দেখে যা রে মাইজভান্ডারে’। একে তো দরবারের গান বাইরে, তার ওপর নারীকণ্ঠে। কত বাধাই যে এসেছে! এমনও হয়েছে আমরা অনুষ্ঠানে গান করছি। মাঝখানে মানুষজন গন্ডগোল পাকিয়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করে দিল। এ রকম অসংখ্য ঘটনা। মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়তাম। কিন্তু গফুর দাদা নাছোড়। শুধু বলতেন, ‘তুই ভয় পাবি না। মাইজভান্ডারি গান তুই গাইবি।’ শেষে তো এমন হলো মাইজভান্ডারি গানের জন্যই আমার ডাক পড়ে বেশি। গ্রামোফোন রেকর্ড ও অডিও অ্যালবামে সেই গান ছড়িয়ে পড়ল চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে।

প্রতি বাংলা মাসের ২২ তারিখ তাঁর পটিয়ার বাড়িতে বসে মাইজভান্ডারি ও বিচ্ছেদি গানের আসর। আমাকে বলে গেছেন, ‘এই আসর যেন বন্ধ না হয়। তুই চালিয়ে নিয়ে যাবি।’
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানেও তিনি সাড়া জাগিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ গানটিও প্রথম আমার গলায় তুলে দেন। এ ছাড়া ‘মাইট্যা কলসি’, ‘ঘুম যারে দুধর বাচা’, ‘ঘরের চালত বইস্যে এক জোড়া কইতর’, ‘রাঙ্গুনিয়া বাপের বাড়ি’—গফুর দাদার লেখা অসংখ্য গান গেয়ে শ্রোতার মন জয় করার চেষ্টা করেছি। এমন গুণী এই মানুষটি আমাকে স্নেহ করতেন। এটা ছিল আমার পরম সৌভাগ্য। আমার শিল্পীজীবনের এটা শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমাকে কল্যাণী ঘোষ করে গড়ে তোলার পেছনেও আছে একটি গল্প। ঘটনাটা ১৯৭৭ সালের শেষ দিকের। কক্সবাজারের চকরিয়ার আজিজনগরে শেফালী দিদির (কিংবদন্তি শিল্পী শেফালী ঘোষ) একটি অনুষ্ঠান করার কথা ছিল। কিন্তু শেফালী দিদি যেতে পারছেন না। গফুর দাদা বললেন, ‘চল কল্যাণী। তুই যাবি। আর আজ থেকে তোর নাম কল্যাণী সাহা নয়, কল্যাণী ঘোষ।’ ভয়ে ভয়ে আমি গেলাম অনুষ্ঠানে। গানে আসর জমালাম। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল গানের বায়না আসা। আমিও গফুর দাদার সেই নামে পরিচিত হতে থাকলাম।
গফুর দাদা আমাকে তাঁর পরিবারেরই একজন মনে করতেন। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে একটি দল সাক্ষাৎকারের জন্য আসে তাঁর কাছে। সে সময় আমি পাশে ছিলাম।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় আপনার পরিবারের কেউ কি গান করেন? তিনি হাত তুলের দেখিয়ে দেন আমাকে। শেষ দিকে এসে তো কোনো গান ভুলে গেলে আমাকে ফোন দিতেন—‘কল্যাণী বলত, এই গানটি কি আমার? ওই গানটার অন্তরার প্রথম লাইনটা একটু গেয়ে শোনাত।’ সেই ফোনটি আর আসবে না।
মনের দিক থেকেও বেশ বড় মাপের শিল্পী ছিলেন তিনি। পুরোনো গীতিকারদের মানুষের কাছে পরিচিত করাতে চেষ্টা ছিল নিরন্তর। একটি অ্যালবামে ১২টি গান থাকলেও সেখানে তিনি নিজের গান দিতেন মাত্র দুটি। অথচ চাইলে সব গানই তাঁর দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করতেন না। আসকর আলী পণ্ডিতের গান ‘কি জ্বালা দি গেলা মোরে’, ‘ডালেতে লরি ছড়ি’, ‘এক সের পাবি/ দেড় সের খাবি’ এসব গান তো মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছেন গফুর হালী।
তবে এত কিছু করে যাওয়া পরও এই মানুষটির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পাননি। এটা তো আমাদের জন্য বড় দুর্ভাগ্য। গুণীর যথাযথ কদর হলো না।