গান্ধী বনাম গান্ধী

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ও মানেকা গান্ধী
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ও মানেকা গান্ধী

চরম তিক্ততার মধ্যেও সৌভ্রাতৃত্বের একটা ক্ষীণ বন্ধন ছিল। ভোটে জেতার অমোঘ তাগিদ সেটুকুও ছিন্ন করে দিল। বিচ্ছেদ আপাতত চূড়ান্ত। বৃত্তটিও পূর্ণ।
অথচ এমনটা না-ও হতে পারত। চার বছর আগেও তো একটা ভোট হয়েছিল। তখনো তো কত অকথা-কুকথার ফুলঝুরি ঝরেছিল। ‘হেট স্পিচ’-এর অপরাধে সেবার পিলিভিটের প্রার্থী বিজেপির ফিরোজ বরুণ গান্ধীকে জেলেও যেতে হয়েছিল। কই, ভাইয়ে-ভাইয়ে বা ভাই-বোনের কেউই তো তখন শালীনতার লক্ষ্মণরেখা ডিঙোননি? ভাই রাহুল অথবা বোন প্রিয়াঙ্কাও তো ‘আদর্শের যুদ্ধ’ শুরু করার কথা বলেননি? তাহলে? কী হলো এবার যা সৌভ্রাতৃত্বের নড়বড়ে সাঁকোটাকে এভাবে উপড়ে দিল? সেটাও কি ওই ‘মোদি অ্যাফেক্ট?’ নাকি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের ক্রমেই পিছু হটা গান্ধীদের বড় তরফকে হতোদ্যম করে তুলেছে? প্রশ্ন অনেক, উত্তর যদিও নেই।
অবশ্য এমনটা হওয়ার যাবতীয় উপাদান সেই কবে থেকে মজুত। ব-ত্রি-শটা বছর! ১৯৮০ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে তেত্রিশ বছরের সঞ্জয় যেদিন বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, বরুণের বয়স তখন তিন মাস ১০দিন। ঠিক দু বছরের মাথায় ছাব্বিশ বছরের বিধবা মানেকাকে ১, সফদরজং রোডের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির লনে মানেকার বাক্সপেটরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দু বছরের শিশুপুত্র বরুণকে কোলে নিয়ে মানেকা উঠে এসেছিলেন এমন একটি বাড়িতে যেখানে, বাইশটা কুকুর থাকত। সনাতন ভারতে অকাল-বিধবা পুত্রবধূর গৃহত্যাগ নিয়ে সেই সময় সে কী বিপুল আলোড়ন! পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর যুক্তিজাল। ঘরে ঘরে টানা হলো বিভাজনরেখা। যে খুশবন্ত সিং জরুরি অবস্থা জারিকে সমর্থন করে ইন্দিরার গুণগান গেয়েছিলেন, তিনিও শাশুড়িকে ছেড়ে বউমার পাশে দাঁড়ালেন। শুরু হলো ভারতের এক নম্বর রাজনৈতিক পরিবারের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
বিচ্ছেদ ও বিভেদের বীজ অবশ্য পোঁতা হয়েছিল তারও আগে। মানেকা ছিলেন স্বামীর মতোই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী। আমেথির সাংসদ হয়েছিলেন সঞ্জয় তাঁর মৃত্যুর বছরেই। ১৯৮০ সালে। স্বামীর আচমকা মৃত্যুর পর একটু ধাতস্থ হয়ে মানেকা যেই আমেথি থেকে উপনির্বাচনে দাঁড়ানোর গোঁ ধরলেন, প্রতিরোধের বীজটাও তখনই

পোঁতা হলো। ইন্দিরা রাজি নন। মানেকাও নাছোড়বান্দা। ইন্দিরা তত দিনে বড় পুত্র রাজীবকে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার দেবেন ঠিক করে ফেলেছেন। আমেথির উপনির্বাচনে রাজীবই হলেন কংগ্রেসের প্রার্থী। ক্ষিপ্ত মানেকা গঠন করলেন তাঁর নতুন দল, ন্যাশনাল সঞ্জয় ফোরাম। পরের বছরই তিনি ঠাঁইনাড়া হলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে একটা চিঠি লিখে সেটা সাংবাদিকদের হাতেও তুলে দেন প্রকাশের জন্য। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘...যে অসম্মান ও শারীরিক-মানসিক অত্যাচার ওই বাড়িতে আমায় করা হয়েছে, কোনো মানুষকে তা সহ্য করতে হয়নি। সঞ্জয়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আপনি সব রকমভাবে অত্যাচার শুরু করেন...।’ সেই থেকে কী না হয়নি এই দুই পরিবারে? বরুণের চার বছর বয়সের জন্মদিনে তাকে কাছে পেতে ইন্দিরা আইনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সোনিয়া গিয়েছিলেন তার স্কুলে মিষ্টি ও টফি দিতে। সঙ্গে ছিল একগাদা নিরাপত্তারক্ষী। উদ্বিগ্ন মানেকা স্কুলে গিয়ে ছেলেকে বাড়ি এনে শাশুড়ির বিরুদ্ধে অপহরণ চেষ্টার মামলা ঠুকেছিলেন। সে এক কাণ্ড।
অতঃপর শুরু একাকী জীবনে থিতু হতে এক তরুণীর সংগ্রামের কাহিনি। পাশাপাশি এক শিশুরও নির্বান্ধব ও প্রায় অবহেলিত জীবন। স্কুলজীবন শেষ করে বরুণ চলে যান ইংল্যান্ডে। কবিতা তখন তাঁর প্রেম, ইতিহাস পাঠ নেশা। রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কও অত্যন্ত গভীর। পড়া শেষ করে ২০০৪ সালে লন্ডন থেকে দিল্লি ফিরেই বরুণ যান ভাই-বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আপ্লুত সোনিয়াও পারিবারিক তিক্ততাকে পাশে সরিয়ে বরুণকে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন। বরুণ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না। ঠিক করলেন রাজনীতি যদি করতেই হয় মায়ের পাশে থেকেই করবেন। মায়ের কাছেই চলল তাঁর রাজনীতির পাঠ। ২০০৯ সালে মায়েরই কেন্দ্র পিলিভিট থেকে তিনি বিজেপির টিকিটে জিতে সাংসদ হলেন। তার ঠিক আগেই সেই কুখ্যাত ‘হেট স্পিচ’ এবং জেলযাত্রা।
এবার যা থেকে ভাই-বোনের বাগ্যুদ্ধের সূত্রপাত এবং ক্রমশ যাতে জড়িয়ে পড়লেন মানেকাও, ২০০৯ সালের ‘হেট স্পিচ’-এর তুলনায় তা কিন্তু নিতান্তই সাদামাটা। শুরুটা বরং প্রশংসা দিয়েই। রাহুলের আমেথির কিছু কাজকর্ম ভালো বলে মন্তব্য করে ফেঁসে যান বরুণ। নরেন্দ্র মোদিকে সারথী করে যে-দলটা কংগ্রেসকে উৎখাত করার ধনুর্ভঙ্গপণ করেছে, বরুণ কিনা সেই ‘শাহজাদা’-র স্তুতি করছে! দল হুকুম দিল বরুণকে মন্তব্য পাল্টানোর। বরুণ বললেন, মিডিয়া তাঁর মন্তব্যের ভুল বাখ্যা করেছে। এই পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্তু সেটাকে বেঠিক করে তুললেন খোদ মানেকাই। বললেন, ‘বরুণ না জেনেশুনে কথা বলেছে। আমি তো আমেথিতে কোনো উন্নয়নই দেখতে পাইনি।’ এর ঠিক দুদিন পর কর্মিসভায় প্রিয়াঙ্কার ভাষণের একটি চোরা ভিডিও ক্লিপিং মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করল। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রিয়াঙ্কা বলছেন, ‘বরুণ বিজেপিতে যোগ দিয়ে উচ্ছন্নে গেছে। ওকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনা দরকার।’ এক দিন পরে আবার, ‘এটা কোনো পারিবারিক চায়ের আড্ডা নয়। নির্বাচন হলো একটা আদর্শের যুদ্ধ। যে কেউ সেই আদর্শের অন্য প্রান্তে থাকবে, তাকে আমি ক্ষমা করব না। তার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকলেও নয়। এমনকি নিজের সন্তান হলেও নয়। আগের ভোটেও ও (বরুণ) অনেক কথা বলেছিল। আমি ওর সঙ্গে একমত নই। আমার বাবা দেশের একতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। কারও জন্য আমি তাঁর আদর্শকে অসম্মান করতে পারব না। এমনকি নিজের সন্তানের জন্যও নয়।’
বরুণ ও মানেকাও এরপর সুর আরও চড়ালেন। বরুণ বললেন, ‘প্রিয়াঙ্কা শালীনতার লক্ষণরেখা অতিক্রম করছে। আমার ঔদার্যকে কেউ যেন আমার দুর্বলতা বলে মনে না করে।’ আর, তীব্র কটাক্ষে মানেকা বললেন, ‘আদর্শ? আদর্শের বিষয়টা প্রিয়াঙ্কা বরং তার স্বামী রবার্টকে জিজ্ঞেস করুক। তাহলেই সে বরুণের সঙ্গে পার্থক্যটা বুঝতে পারবে।’
রাজনীতি দূরকে যেমন আপন করে, আপনকেও তেমন পর করে দেয়। বত্রিশ বছর আগে যে শত্রুতার জন্ম হয়েছিল, বত্রিশ বছর পর তা পূর্ণতা পেল। গান্ধী বনাম গান্ধী পারিবারিক বৈরিতার মধ্যে এত দিন রাহুল-প্রিয়াঙ্কা-বরুণই ছিলেন ভাই-বোনের সুসম্পর্কের এক সুতোর বন্ধন। আবার কখনো এক হওয়ার ক্ষীণতম আশার সম্ভাবনাও। ও’হেনরির বিখ্যাত দ্য লাস্ট লিফ-এর সেই একমাত্র বৃক্ষপল্লবটির মতো। এবারের ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতার ক্ষুরধার ধর্মযুদ্ধ সেই বন্ধনটিও ছিন্ন করে দিল।