আঁকা: জুনায়েদ

১৯৯৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আমার জীবনে আবির্ভূত হয়েছিল ভীষণ এক আপদের মতো। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সকালে স্কুলে যাই, বিকেলে সাইকেল চালাই, আর সন্ধ্যাবেলা দুলে দুলে কুসুমকুমারী দাশের কবিতা মুখস্থ করি:

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?

মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন

‘মানুষ হইতে হবে’—এই যার পণ।’

আমার বাবার ধারণা ছিল, ‘মানুষ হইতে হইলে’ শুধু কবিতা মুখস্থ করলে হবে না, দেশের নামও মুখস্থ করতে হবে। ভূগোল জ্ঞান থাকতে হবে। অতএব বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে তিনি আমার হাতে ফিকশ্চার ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এখানে ৩২টা দেশের নাম আছে। মুখস্থ করে ফেলো।’ আমার দাঁতের সংখ্যা তখনো ৩২ হয়নি। অতএব, ‘এতগুলো দেশের নাম মুখস্থ করে কী লাভ?’ —এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করার অধিকার আমার ছিল না। সুতরাং লক্ষ্মী ছেলের মতো দুলে দুলে সবগুলো দেশের নাম মুখস্থ করে ফেললাম।

তাতে বিপদ বাড়ল আরও! বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে বড়রা যেভাবে বলে, ‘বাবু, একটা ছড়া শোনাও তো।’ আমাকে সেভাবে দেশের নাম ‘আবৃত্তি’ করে শোনানোর অনুরোধ রক্ষা করতে হতো। দিকে দিকে আমার ‘পারফরমেন্স’ এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এর মাজেজা তখন বুঝতাম না। তবে কোন গ্রুপে কোন দল আছে, সব গড়গড় করে বলে দিতে পারতাম। দেশের নাম মুখস্থ করতে গিয়ে অবশ্য একটা কাজের কাজ হলো। ৩২টি দেশের পতাকা আমার চেনা হয়ে গেল। বিভিন্ন দেশের পতাকা দেখিয়ে কাজিনদের, স্কুলের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করতাম, ‘বল তো এটা কোন দেশের পতাকা?’ কেউ ঠিকঠাক বলতে না পারলে আমার কী যে আনন্দ হতো!

২০০২ সালে যখন আবার বিশ্বকাপ এল, তত দিনে আমিও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল যুদ্ধে শামিল হয়েছি। উত্তরাধিকার সূত্রে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করতাম। আর ‘ভাতৃঅধিকার সূত্রে’ ভালো লাগত গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার খেলা। ‘ক্রাশ’ শব্দটা তখনো চালু হয়নি। অতএব আমার বড় বোনকে স্রেফ ‘ভক্ত’ হয়েই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছিল। ভক্তের ভক্তির দাপটে আমাদের বাসার পত্রিকাটা দেখাত শতচ্ছিন্ন পোশাকের মতো। পত্রিকায় বাতিস্তুতার যত ছবি ছাপা হতো, সব সে কেটে রাখত। সেই ছবি আবার যত্ন করে আঠা দিয়ে লাগানো হতো খাতায়।

তখন কি আর জানতাম, একদিন এমন এক প্রযুক্তি পৃথিবীতে আসবে, যেখানে ক্লিক করলেই খুলে যাবে বাতিস্তুতার ছবিওয়ালা হাজার পৃষ্ঠার খাতা! সে খাতার নাম গুগল। তখনকার দিনে বাতিস্তুতার খেলা দেখতে হলে বিটিভির বদান্যতার অপেক্ষায় থাকতে হতো। এখন ইউটিউব মহাশয়কে বললেই তিনি হাজির করে দেন কত কী খেলার ভিডিও! ড্রয়িং রুম কিংবা চায়ের দোকানে তর্ক হতো—রোনালদো ভালো খেলে, নাকি জিনেদান জিদান? এখন বোধ হয় ঝগড়াঝাঁটি ফেসবুকেই বেশি জমে।

আমার ভাগনেটা পড়ে ক্লাস ওয়ানে। ৩২টা দেশের নাম তার জানা নেই বটে। কিন্তু ভূগোল জ্ঞান সম্ভবত আমার চেয়ে তার কম নয়। সারা দিন আইপ্যাড নিয়ে বসে থাকে। যে কোনো দেশের নাম বললে সে চট করে গুগল ম্যাপে দেশটা দেখে নিতে পারে। উইকিপিডিয়া দেখে গড় গড় করে বলে দেয় সে দেশের জনসংখ্যা, আয়তন, ভাষা ইত্যাদি।

ফুটবলের উন্মাদনা আর আনন্দ তাকেও ছুঁয়ে যায়। সেই ১৯৯৮ বা ২০০২ সালে আমরা ফুটবল খেলা দেখে যে আনন্দ পেতাম, এখনকার শিশুদের কাছেও কি আনন্দটা একই রকম? বড় কঠিন প্রশ্ন। এমনকি এ প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় গুগলের কাছেও নেই।