ঘরের কাজে ঘরের ছেলে


মিনা-রাজুর সেই গল্পটা মনে আছে? সেই যে মিনা আর রাজু, দুই ভাইবোন একদিন নিজেদের কাজগুলো বদলাবদলি করে নিল। রাতে খেতে বসে রাজুর সে কি লম্বা ফিরিস্তি, ‘আইজ সারা দিন আমি ম্যালা কাম করছি। চুলা জ্বালাইছি, বাসন মাজছি, মুরগিরে খাওন দিছি, পানি আনছি...মিনার সব কাম করছি।’ একটা দিন বোনের কাজ করেই হাঁপিয়ে উঠেছিল রাজু। দিন শেষে দুই ভাইবোন ঠিক করেছিল, এখন থেকে বাড়ির কাজগুলোতে একে অপরকে সাহায্য করবে।
ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার বার্তা ছোটবেলার সেই এক মিনা কার্টুনে ছাড়া আমরা খুব একটা পাই না। এখনো সয়াবিন তেলের বিজ্ঞাপনে নারীরা থাকেন মূল ভূমিকায়। টিভির পর্দায় ওয়াশিং পাউডারের প্যাকেট হাতে, কোমরে আঁচল গুঁজে বাড়ির গৃহিণীই দাঁড়ান। নাটক-সিনেমায় রান্নাঘরের দৃশ্যগুলো বেশির ভাগ সময় থাকে মা-ভাবি-বোন-বউদের দখলে। কিংবা আমাদের পরিবারগুলোর কথাই ধরুন। বেশির ভাগ সময় ছোটবেলা থেকে মা বা বোনের আদরে বেড়ে ওঠা বাড়ির ছেলেটার গৃহস্থালি কাজ করার অভ্যাস আর হয় কোথায়?

সমাজের এই ‘শিক্ষা’ উপেক্ষা করে অনেক ছেলেরাই ঘরের কাজ নিজেই করেন। ছুটির দিনে বা বাড়িতে অতিথি এলে রান্নার দায়িত্বটা অনেকে নিজের কাঁধে নিয়ে নেন, থালাবাসন-কাপড়চোপড় নিজেই ধুয়ে ফেলতে অভ্যস্ত কেউ কেউ। বন্ধুরা হয়তো টিপ্পনী কাটে, বিবাহিত পুরুষেরা পান ‘স্ত্রৈণ’ অপবাদ। তবু বিশ্বাস করুন, ঘরের কাজ পুরুষদের সুখী রাখে। মানসিক শান্তি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজসহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এমনটাই বলছেন।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী রেজাউর রহমান। রসনাশিল্পে তাঁর অভিজ্ঞতা একেবারেই নেই, স্বীকার করে নিয়ে বললেন, ‘বাসায় রান্না ছাড়া সব কাজই আমি করি। অনেক ছেলেরা একটু অগোছালো থাকে। আমার ব্যাপারটা ভিন্ন।

ছোটবেলা থেকে মা সব সময় নিজের ঘর গুছিয়ে রাখতে শিখিয়েছেন। সেই অভ্যাস এখনো আছে। সবকিছু পরিপাটি, পরিষ্কার দেখতে ভালো লাগে। তাই ঘর গোছানো নিয়ে আমার স্ত্রীকে ভাবতে হয় না। ও শুধু রান্নার দিকটাই দেখে।’ অনেক ছেলে আবার গৃহস্থালি কাজকে আদৌ তেমন কোনো ‘কাজ’ মনে করেন না। থালা বাসন ধোয়া, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা...এ আর এমন কি? রেজাউর একেবারেই একমত নন। ‘সারা দিন পর বাড়ি ফিরে যারা সবকিছু ঠিকঠাক হাতে পান, তাঁদের কাছে সহজ মনে হতে পারে। নিজে করতে গেলে বোঝা যায়, কাজটা কতটা ক্লান্তিকর। যাঁরা নয়টা-পাঁচটা অফিস করেন; ভেবে দেখেন, অফিসে হয়তো আপনাকে প্রতিদিন নতুন নতুন কাজ করতে হচ্ছে। ঘরের কাজগুলো কিন্তু প্রতিদিন একই। এটা আসলে অভ্যাস আর রুচির ব্যাপার।’ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহসান আরেফিন জানালেন তাঁর অভ্যস্ততার কথা। ‘ছোটবেলা থেকে আব্বু-আম্মু শিখিয়েছেন, নিজের ঘর নিজেকে গোছাতে হবে, নিজের কাপড় নিজেকে ধুতে হবে। শুধু আমি না। আমার ছোট ভাইটা ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওর ঘর ও-ই গুছিয়ে রাখে। সকালে নাশতা নিজেই একটা কিছু তৈরি করে খেয়ে নিয়ে স্কুলে যায়। বাসায় রান্না যেমন বেশির ভাগ সময় আব্বুই করে। সবাই মিলেই আসলে করি। আমার কাছে মনে হয়, এর মাধ্যমে লাইফস্টাইলে একটা শৃঙ্খলা আসে।’

গৃহস্থালি কাজ যে পুরুষদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনে, মানসিক শান্তি দেয়, পরিবারকে সুখী করে—সে নিশ্চয়তা দিলেন মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামালও। বলছিলেন, ‘ঘরের কাজগুলো মেয়েরা করবে, এ ধরনের একটা ভাবনা আমাদের জিনগত চেতনায় সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এ ধারণাটা এখন বদল হচ্ছে। মানুষ সব সময় ঘরে-বাইরে সুখের খোঁজে থাকে। ঘরে তাঁর নিজের দায়িত্ব পালন, নিজের কাজগুলো করার মধ্য দিয়ে সম্পর্কে বিশ্বাস তৈরি হয়। পরিবারে সুখ থাকে।’ শুধু সুখের খোঁজেই নয়, গৃহস্থালি কাজগুলো একজন পুরুষের ‘দায়িত্ব’ বলেই মনে করেন মডেল নোবেল। বলছিলেন, ‘একজন ক্রিকেটারকে যেমন ক্রিকেট মাঠে ভালো মতো খেলতে হয়, একজন শিক্ষককে যেমন তাঁর প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ঠিকমতো পড়াতে হয়, সে রকম বাড়ি ফিরে ঘরের কাজগুলো করাও একজন পুরুষের দায়িত্ব। ব্যস্ততার কারণে কিংবা অজুহাতে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। বাসায় আমি যতটুকু সম্ভব আমার দায়িত্বটা পালন করতে চেষ্টা করি।’
কৃতজ্ঞতা: রাহিমা সুলতানা