ঘরের সামনেই কল, পানির কষ্ট নেই

পাড়ার তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি ঝরনা। ঝরনা থেকে পাইপের মাধ্যমে পাড়ার কাছেই স্থাপিত ট্যাংকে জমা হচ্ছে পানি। সেই পানি আবার ঘরে ঘরে পৌঁছেও দেওয়া হচ্ছে। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের চৈ ছড়ি মোনপাড়া থেকে ২২ নভেম্বর ছবিটি তুলেছেন সুপ্রিয় চাকমা
পাড়ার তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি ঝরনা। ঝরনা থেকে পাইপের মাধ্যমে পাড়ার কাছেই স্থাপিত ট্যাংকে জমা হচ্ছে পানি। সেই পানি আবার ঘরে ঘরে পৌঁছেও দেওয়া হচ্ছে। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের চৈ ছড়ি মোনপাড়া থেকে ২২ নভেম্বর ছবিটি তুলেছেন সুপ্রিয় চাকমা

শুষ্ক মৌসুম এলেই গ্রামবাসীর ভোগান্তি। ছড়া শুকিয়ে পানির জন্য চলত হাহাকার। দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়েও পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যেত না। লেগে থাকত পানিবাহিত রোগ। তবে তা বছর খানেক আগের কথা। সেই কষ্ট এখন অতীত। গ্রামের ঘরে ঘরে এখন পানি সরবরাহ হয়। উঠানেই বসানো হয়েছে কল। ঘরে বসেই পানি পাচ্ছেন গৃহবধূরা।

এই গ্রামের নাম চৈ ছড়ি মোনপাড়া। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নে ঘিলাছড়ি বাজার থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রামটির অবস্থান।

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আশির দশকের দিকে ঘিলাছড়িতে আশ্রয় নেন এসব মানুষ। বসতি শুরুর পর থেকে গ্রামবাসী সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কৃষিকাজ তাঁদের আয়ের মূল উৎস। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির পর গ্রামের আশপাশে ব্যাপক বন ধ্বংস করা হয়। এরপর থেকে চৈ ছড়ি ছড়াতে পানি কমে যায়। বর্ষায় ছড়ায় পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে চলত হাহাকার। এই ছাড়াটি গ্রামের ৪৫টি পরিবারের পানির একমাত্র উৎস।

গ্রামের বাসিন্দা পূর্ণ শোভা চাকমা জানান, ২০০৮ সালে পানির সংকট নিয়ে গ্রামের লোকজন বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয় চৈ ছড়ি গ্রামের আশপাশে পাঁচ কিলোমিটারে বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। সৃষ্টি হয় ঝরনা। কিন্তু এই ঝরনা গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। এরপর ২০১৩ সালে এসে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রগ্রেসিভের সহযোগিতায় ওই ঝরনার পানি পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িতে সরবরাহ করা শুরু হয়। এতে ব্যয় হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।

সরেজমিনে দেখা যায়, চৈ ছড়ি মোনপাড়া গ্রামের মাঝখানে বয়ে গেছে ছড়াটি। ছড়ার দুই পাড়ে গ্রামের ঘরবাড়ি। গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের ঝরনা থেকে পানি পাইপের মাধ্যমে আসছে গ্রামের পাশের পানির ট্যাংকে। তিন হাজার লিটারের এই ট্যাংক থেকে ঘরে ঘরে চলে যাচ্ছে পানি। গ্রামের একেকটি ঘরের দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ গজ দূরত্বে। এসব ঘরের সামনে রয়েছে একটি করে কল। এই কলে ২৪ ঘণ্টাই পানি থাকছে।

গৃহবধূ মিনতি বালা চাকমা বলেন, একসময় পানির জন্য ভোর থেকে ছোটাছুটি করতে হতো। পানির জন্য সারাক্ষণ চিন্তা হতো। এখন সহজে পানি পাওয়া যায়।

ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান অমর জীবন চাকমা বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে নলকূপ কিংবা রিংওয়েল (পাতকুয়া) বসানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু চৈ ছড়ি গ্রামজুড়ে পাথর হওয়ায় বসানো সম্ভব হয়নি। বন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সংস্থা প্রগ্রেসিভ পানি সরবরাহের উদ্যোগ না নিলে পানির অভাবে এখানকার মানুষকে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হতো।’

নিজের বাড়ির আঙিনায় কল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন চৈ ছড়ি মোনপাড়ার এক বাসিন্দা l প্রথম আলো
নিজের বাড়ির আঙিনায় কল থেকে পানি সংগ্রহ করছেন চৈ ছড়ি মোনপাড়ার এক বাসিন্দা l প্রথম আলো

প্রগ্রেসিভের নির্বাহী পরিচালক সুচরিতা চাকমা বলেন, এনজিও ফোরামের সহযোগিতা ও চৈছড়ি গ্রামের লোকজনের আন্তরিকতায় পানি সরবরাহের কাজ সম্ভব হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রকল্প শুরু হয়েছে। গ্রামে পানি সরবরাহ শুরু হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে। আগামী ডিসেম্বর মাসে এই প্রকল্প শেষ হবে। এরপর এই কার্যক্রম স্থানীয় লোকজনের তত্ত্বাবধানে চলবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা মূলত ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করি। আমাদের এসব কার্যক্রম দেখে ইউনিয়ন পরিষদ ব্যবস্থা নেবে। চৈছড়ি গ্রামে এ পর্যন্ত কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা কাজ করেনি।