চলনবিল। নাম শুনলেই গা ছমছম করে ওঠে। থইথই জলে উথালপাতাল ঢেউ। দিগন্তছোঁয়া জলরাশির বিস্তৃতি মনে তৈরি করে অজানা ভীতি। তবে এ রূপ বর্ষার। ষড়্ঋতুর দেশে মনবদলের মতোই রূপ বদলায় চলনবিল। বর্ষায় পূর্ণ যৌবনা হয়, শরতে সাজে সবুজে। হেমন্তে পাকা ধান আর সোঁদা মাটির গন্ধে ম–ম করে চারদিক।
রূপবদলের এই বৈচিত্র্যে শরতের চলনবিল যেন আলাদা এক ভালো লাগা। দিগন্তজোড়া সবুজের মধ্যে হঠাৎ জলের ধারা। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নানা রঙের ফুল, হরেক পাখির কলরব। এখানে–সেখানে মাছ শিকারের ধুম। এ যেন এক অপরূপ সাজ। তাই চলনবিলে বেড়ানোর জন্য শরৎই শ্রেষ্ঠ সময়।
কথিত আছে, এ বিলের বুকে প্রমোদতরি ভাসিয়ে একসময় রাজা-বাদশাহ, পাঠান, মোগলরা নিদারুণ ক্লান্তি ঝেড়েছেন। পর্যটকেরা চলনবিলের বিশালতা দেখে অভিভূত হয়েছেন। লেখকেরা রচনা করেছেন নানা কাহিনি। চলনবিলের মাছে ভোজ হয়েছে বনিয়াদদের। কালের বিবর্তে এসবের অনেকটাই এখন বিবর্ণ। বিলের তলদেশে পলি জমে ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিশালতা। এরপরেও স্বরূপের জানান দিয়ে নানা সাজে ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করে চলনবিল। শরতের আকাশ শুভ্রতায় ভরে দেয় ক্লান্ত মনকে। খাল–বিল, নদীর জলরাশি আর সবুজের বিশালয় মুগ্ধ হয় দুই নয়ন। নেওয়া যায় নানান জাতের টাটকা দেশি মাছের স্বাদ। পাখির কলরব শান্ত করে হৃদয়।
চলনবিল একটি বিল নয়
বিশাল এই বিলাঞ্চলকে কেন চলনবিল নামে ডাকা হয়, এর সঠিক জবাব মেলেনি আজও। কথিত আছে, দুই হাজার বছর আগেও চলনবিল নামের অস্তিত্ব ছিল না। অঞ্চলটি ছিল তখন সমুদ্রগর্ভে। কালের আবর্তে সমুদ্র সরে যায় আরও দক্ষিণে। ব্রিটিশ গেজেটিয়ারে উল্লেখ রয়েছে, সমুদ্র সরে যাওয়ার পর তার স্মৃতি ধরে রেখেছে চলনবিল। অন্যান্য বিলের মতো এই বিল স্থির নয়। হয়তো নদীর মতো এতে স্রোত ছিল বলেই এর নাম হয়েছিল চলনবিল।
বর্তমানে চলনবিলে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন, ৮টি পৌরসভা ও ১ হাজার ৬০০টি গ্রাম রয়েছে। লোকসংখ্যা ২০ লক্ষাধিক। বিস্তীর্ণ চলনবিলের মধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন নামে ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনের ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল ও অসংখ্য পুকুর।
চলনবিলকে একসময় বলা হতো মাছের বাড়ি। দেশি প্রজাতির নানান মাছে ভরপুর ছিল চলনবিল। এ বিলের মাছ ট্রেনযোগে যেত পশ্চিমবঙ্গে। সেখানকার বনিয়াদরা চলনবিলের মাছ দিয়ে ভোজে মাততেন। এখন তেমনটি না থাকলে বহু প্রজাতির দেশি মাছে দেখা মিলবে বিলে। এর মধ্যে রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কই, শোল, গজার, টাকি, বাইন, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, টাটকিনি, ভেদা ও চাঁদা উল্লেখযোগ্য। বিলের যেখানেই পানি আছে, সেখানেই চোখে পড়বে মাছ ধরার ধুম। সুতিজাল, ভেশাল, খড়া জাল, দোয়ার, চাঁই, বড়শিসহ বিভিন্ন মাছ ধরার যন্ত্র নিয়ে মেতে আছে শিশু-কিশোর, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ।
শরতের চলনবিলে রূপবিকাশে আরেকটি বৈচিত্র্য হচ্ছে ফুল। গাছে গাছে কত না ফুল ফোটে এই সময়ে। এর মধ্যে কামিনী, কদম, শিউলি ও হাসনাহেনা গন্ধ ছাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে। এ ছাড়া শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানা তো আছেই। আর নানা রঙের বুনো ফুল দেখা যাবে বিলজুড়ে। বিভিন্ন জলজ গাছ ও ধানের আইলে দেখা মিলবে হরেক রকম ফুল।
বর্ষার বিস্তীর্ণ জলরাশিতে দেখা মেলে গাঙচিলেদের ছোটোছুটি। রঙিন মাছরাঙার শিকার ধরা তো আছেই। শরতের সময়টাতে মিলবে সবুজ ধানের খেতে সাদা বক আর জলরাশিতে পানকৌড়িদের ডুবসাঁতার খেলা। এ ছাড়া শালিক, ডাহুক, ফিঙে, দোয়েল তো আছেই।
চলনবিলের কী দেখবেন
বিশাল বিল, জলরাশি, সবুজ ধানখেত, ফুল, পাখির পাশাপাশি চলনবিলে বেড়াতে গেলে পরিচয় হবে কিছু দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে। এর মধ্যে পাবনার চাটমোহরে শাহি মসজিদ, জগন্নাথমন্দির, ফরিদপুরের বনওয়ারীনগর জমিদারবাড়ি, সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দেখা যাবে রাধাগোবিন্দ মন্দির, রশিকমন্দির, শিবমন্দির, বড় কুঞ্জবন দিঘি, উলিপুর দিঘি, মথুরা দিঘি, মাকরসন দিঘি। তাড়াশের কাছে পিঠে বিনসারা গ্রাম। সেখানে গিয়ে দেখা মিলবে কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বসতভিটা ‘জীয়ন কূপ’। এ ছাড়া নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুর গ্রামে দেখা যাবে চলনবিল জাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলের নানা ঐতিহ্য।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা অথবা পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর। সবখানেই বাসযোগে আসা যাবে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে এলে চাটমোহর অথবা ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ স্টেশনে নেমে চলনবিল ঘোরা যাবে। দেশের অন্য যেকোনো স্থান থেকেই খুব সহজে বাসে আসা যাবে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা। কাছিকাটা নামলে সেখান থেকে ছোট–বড় নৌকায় চলনবিল ঘোরা যাবে। অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত নৌকায় বিলের রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়ানো যাবে। কাছিকাটা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে চাটমোহর বাজার। এখানে এলে মিলবে সুস্বাদু রসমালাই।