চল পালিয়ে যাই

.
.

রিদনের রিপা আপুর বিয়ে হলো আজ। গত বছর এসএসসি পাস করেছে রিপা। মনে প্রবল ইচ্ছে থাকলেও আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি ওর। কান্নাকাটি, অনশন কিছুতেই কিছু হয়নি। মেয়ে মানুষ এসএসসি পাস করেছে, এটাই অনেক। এত পড়ে হবেটা কী? এবার বিয়ে-শাদি করে সংসারে মন দিক। ছেলে-পুলে মানুষ করতে হবে না? রিদনের বাবা মোতাহার মিয়া এভাবেই বুঝিয়েছিলেন মেয়েকে। বাবার এমন ‘অকাট্য’ যুক্তি খণ্ডনের সাহস দেখায়নি মেয়ে।
বিয়েটা বলতে গেলে মোতাহার মিয়ার একক পছন্দেই হলো। রিদনের মা জানতে পারলে শুরুতেই ভেস্তে যেত। একটা না একটা খুঁত ধরতেনই ভদ্রমহিলা। ছেলের বাবা নেই, বড় সংসার, ছেলের বয়স বেশি, আরও যে কত কিছু! এত দেখলে কি বিয়ে হয়? তাই চুপিচুপি মেয়ের বিয়ে ঠিক করে এসেছিলেন মোতাহার মিয়া। ছেলে নাকি ঢাকায় বড় চাকরি করে। খুব ব্যস্ত মানুষ। মোতাহার মিয়াকে সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ঈদের দিন ছাড়া তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না! মোতাহার মিয়াও দ্বিমত করেননি। ঠিক আছে। বিয়ে ঈদের দিনেই হবে!
ঠিক তিনটায় বরযাত্রী এল। টেম্পোতে করে। সম্মান বাঁচাতে টেম্পোগুলো দ্রুত বিদায় করে তিনটে মাইক্রোবাস এনে বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলেন মোতাহার মিয়া। খেপে গেলেন বরের চাচা। তারা টেম্পোতে আসুক আর উড়োজাহাজে আসুক সেটা তাদের ব্যাপার। টাকার গরম দেখাবেন কেন মোতাহার মিয়া?
জামাই আসার খবর শুনেও বরণ করতে যাননি জেরিনা বেগম। জামাই তো মোতাহার মিয়ার একার! সেই নাচুক তার পেয়ারের জামাইকে নিয়ে! কনে রিপার মধ্যেও কোনো ভাবান্তর নেই। বউ সেজে জড় পুতুলের মতো অধোবদনে বসে আছে তো আছেই। অবশ্য বসে থাকা ছাড়া তার কোনো কাজও নেই।
দুলাভাই পছন্দ হয়নি রিদনের। দজ্জালের মতো ভুঁড়িওয়ালা একটা লোক ওর দুলাভাই হয় কী করে? এর চেয়ে তারেক ভাই লাখো গুণে ভালো ছিল। লম্বা, ফরসা আর কী স্মার্ট তারেক ভাই! চাকরি ছিল না তাতে কী? চাকরি তো পেতই একদিন। আব্বুটা যে কেন বুঝল না!
সন্ধ্যার পরপরই বিয়ে হয়ে গেল। তবে সুষ্ঠুভাবে না। কবুল বলার আগ মুহূর্তে বরকে থামিয়ে দিলেন বরের মামা। মোটরসাইকেলটা কবে দেওয়া হবে, সেটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত ভাগনেকে কবুল বলতে দেবেন না ভদ্রলোক। মোতাহার মিয়া রেগে গেলেন। এটা কোন ধরনের ছোটলোকি? বউ বিদায়ের আগেই টাকা দিয়ে দেবেন তিনি। শ্বশুরের প্রতিশ্রুতি শুনে মুচকি হাসি দিয়ে কবুল বলল জামাই।
অবশেষে রাত ১২টায় এল বিদায়ের পালা। মেয়ের গলা জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন জেরিনা বেগম। মোতাহার মিয়া দুহাতে চোখ মুছলেন। রিদনের ঝাপসা চোখ রিপার চোখে আটকে গেল। রিপা আপু কাঁদে না কেন?

দুই
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে রিদন। ঘুম আসছে না। সারা দিনের ঘটনাগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে ওর। আচ্ছা, তারেক ভাই বিয়েতে এল না কেন? তারেক ভাইয়ের কথা মনে হতেই চিঠিটার কথা মনে পড়ে গেল রিদনের। গত রাতেই চিঠিটা পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল ওর। ধুর! এ জন্যই আসেননি তারেক ভাই। দাওয়াত ছাড়া এমনি এমনি িক কেউ বিয়েতে আসে? তোশকের িনচ থেকে চিঠিটা বের মুঠোফোনের মৃদু আলোতে পড়তে থাকে রিদন-

‘তারেক,
নির্লজ্জের মতো তোমাকে লিখছি। ফোনটা বন্ধ করে রেখেছ কেন? আমার সামনে এখন দুটি পথ খোলা। প্রথম পথটায় চলতে কোনো বাহন লাগে না। ঘরে একটা সিলিং ফ্যান আর সময়মতো সুযোগ পেলেই হয়। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে করে এ পথের পথিক হতে। কিন্তু ‘মায়া’ নামক দুই অক্ষরের শব্দটাই যে পথ আগলে ধরছে বারবার। নিরুপায় হয়ে হয়তো দ্বিতীয় পথেই হাঁটতে হবে আমাকে। পশুর মতো নিজেকে সঁপে দিতে হবে। পশুদের কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকতে নেই। বাবা বিয়েতে রাজি হলো না বলে তুমি আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে। আমি রাজি হইনি। তোমার কি সে কথা মনে আছে তারেক? যদি মনে থাকে তবে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত তোমার অপেক্ষায় থাকব। একদম দেরি করবে না বলে দিলাম।
-রিপা’
মো. জুনায়েদ খান
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।