
প্রতিদিনের মতো সেদিনও ভোরে ফজরের নামাজ পড়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সী আবুল কালাম। নামাজ শেষে স্ত্রী-সন্তান-নাতি-নাতনিদের নিয়ে ঢাকার শেওড়াপাড়ার নিজের বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন সিলেটের উদ্দেশে। ইচ্ছে ছিল হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করার। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেছিলেন তাঁর একমাত্র ছেলে মো. স্বপন হাওলাদার। মাইক্রোবাসটা ছাড়ে সকাল-সকাল। কে জানত ২৯ মের সেই যাত্রাটাই কাল হয়ে দাঁড়াবে পরিবারটির জন্য!
সকাল ১০টার দিকে মাইক্রোবাসটা চলছিল ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে। স্বপন তখন চালকের পাশে বসে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। চোখ মেলতে না-মেলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলেন সংকুচিত একটা পরিবেশে! উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসা একটা পাথরবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে তাঁদের মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে! নিজের শরীরের আঘাতটা সামলাতে না-সামলাতেই দেখেন চালক মফিজুল ইসলাম আর নেই। পেছনে কী অবস্থা?
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মজলিশপুর এলাকার লোকজন ততক্ষণে ছুটে এসেছেন দুর্ঘটনাস্থলে। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস থেকে মানুষগুলোকে বের করাই দায়। দরজা-জানালা ভেঙে ভেতরের সবাইকে বাইরের আনতে আনতে দেখা গেল, আবুল কালাম মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী রেণু বেগম, তাঁদের পুত্রবধূ মানে স্বপনের স্ত্রী সূচি বেগম ও মেয়ে নূপুর ইসলামেরও কোনো সাড়া নেই। স্বপনের বোন রুমা, নূপুরের মেয়ে সাথী, ছেলে নিলয় গুরুতর আহত। স্বপনের দুই মেয়ে প্রাচী ও ছোট্ট তাসফিয়ারও একই অবস্থা। স্থানীয় লোকজন যে যেভাবে পারলেন আহত ব্যক্তিদের নিয়ে গেলেন আশপাশের হাসপাতালগুলোয়। পথে যেতে যেতেই মারা গেলেন রেণু, নূপুর ও সূচি। এক মুহূর্তের মধ্যে একটা পরিবারের অর্ধেক সদস্য চলে গেলেন পৃথিবী থেকে!
সিলেটে ও পরবর্তী সময়ে ঢাকায় চিকিৎসা নেওয়ার পর পরিবারটির অন্যদের অবস্থা কিছুটা ভালো। তবে ভালো নেই রুমা ও ছোট্ট তাসফিয়া। মোটে দুই বছর বয়স তাসফিয়ার। সারা দিন ‘দাদা দাদা’ বলে ঘুরে বেড়াত ঘরে-বাইরে। দাদা নেই, দাদি নেই, মা-ও চলে গেছেন! তাসফিয়াকে কিছু খাওয়াতে গেলেও টিভির সামনে নিয়ে বসাতে হতো। কার্টুন দেখত, সিনেমার গান দেখত। অথচ এখন সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না! চোখে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে সে। চিকিৎসকেরা বলছেন, খুব শিগগিরই উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা না হলে আরও খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
তাসফিয়ার বাবা স্বপনের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমরা। শক্ত-সমর্থ মানুষটার মাথার ঠিক মাঝ থেকে কপাল পর্যন্ত বড় একটা কাটা দাগ এখনো স্পষ্ট। পরিবারের বাকিদের কেউ এখনো অচেতন, কারও হাত-পা দুটোই ভাঙা। তারপরও তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একসঙ্গে এতজনের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া যে ভীষণ কঠিন, তা বেশ বোঝা যায়। তাই ছোট্ট তাসফিয়ার ব্যাপারে বেশি চিন্তিত স্বপন। তাসফিয়ার ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলছিলেন, ‘তাসফিয়ার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা দরকার। বাকিদেরও চিকিৎসা চলছে। তাই সবাই যদি এগিয়ে আসতেন কিংবা কেউ যদি তাসফিয়ার চিকিৎসার ভার নিতেন, তাহলে খুব ভালো হতো। এই বয়সে মেয়েটা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’
মো. স্বপন হাওলাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে: ০১৭৩০০১৪৯১২