ছবি তোলা ও পোস্ট করা নিয়ে যা জানা দরকার

মুঠোফোনে নিজের ছবি তুলে তা ফেসবুকে আপলোড করছেন? আপনি একা নন। এ রকম ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে আপলোড করেন অনেকেই। মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা থেকে শুরু করে পোপ ফ্রান্সিস কিংবা মহাকাশচারী আকাই হোসাদি, হলিউড কিংবদন্তি মেরিল স্ট্রিপেরও এ ইতিহাস রয়েছে। নিজের ছবি তোলা ও তা শেয়ার করার এ প্রবণতা যাঁকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘সেলফি’। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ব্যবহারের কল্যাণে অনেকের হয়তো এই শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে।
‘সেলফি’কী?
নিজের প্রতিকৃতির ইংরেজি ‘সেলফি’। এটি এ বছর অক্সফোর্ড অভিধানের বর্ষসেরা শব্দ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। অভিধানটির সম্পাদকদের বরাতে এক খবরে বিবিসি জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও নিজের ছবি তোলার ক্ষেত্রে যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহূত হয় তা থেকেই ‘সেলফি’ শব্দটির উত্পত্তি।
অক্সফোর্ড ডিকশনারিজের সম্পাদনা পরিচালক জুডি পারসাল জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নানাভাবে‘সেলফি’ শব্দটিকে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করেছে। ‘সেলফি’কে অক্সফোর্ড অভিধানে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে, একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজেরই তোলা নিজের প্রতিকৃতি, সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েব ক্যামে ধারণ করা এবং তা যে কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড (তুলে দেয়া) করা। অক্সফোর্ড অভিধানের সম্পাদকদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালে একটি অনলাইন ফোরাম প্রথম সেলফি শব্দটি ব্যবহার করেছিল।
সেলফির সংজ্ঞায় আরও বলা যায়, সেলফি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে নিজের মানসিক অবস্থা জানাতে নিজের তোলা বা নিজের সম্পাদনা করা ছবি আপলোড করে ভারচুয়াল বন্ধুদের জানানো। ভারতীয় ছবি-বিষয়ক পরামর্শক নিধি শর্মার মতে, নিজের জীবনের অংশবিশেষ বস্তুনিষ্ঠ করে তুলতে আমরা ভারচুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে নিজের তোলা ছবি শেয়ার না করা পর্যন্ত এ অভিজ্ঞতা যেন পূরণ হয় না।
কীভাবে শুরু হল সেলফি
এক দশক আগে সেলফি শব্দটির উত্পত্তি হলেও কেবল গত বছর এর ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। নিজের তোলা ছবি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের পোস্ট করা বাড়তে শুরু করার সেলফি ও হ্যাসট্যাগ অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয় শব্দ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অক্সফোর্ড অভিধানের সম্পাদকেরা জানিয়েছেন, কেবল ২০১২ সালেই ইংরেজি ভাষায় এ শব্দের ব্যবহার বেড়েছে ১৭ হাজার শতাংশেরও বেশি। সম্পাদকেরা জানিয়েছেন, ইংরেজিভাষীদের উদ্ভাবন করা এরকম নানা শব্দ প্রায়শই ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার হিসেবে অক্সফোর্ডের অভিধানে স্থান পায়। আর এসব শব্দ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত নানা পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে বের হয়ে আসে। অক্সফোর্ড ডিকশনারিজের সম্পাদনা পরিচালক জুডি পারসাল জানান, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নানাভাবে‘সেলফি’ শব্দটিকে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করেছে।
সেলফি প্রজন্মের উত্থান
বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীকে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ব্যবহারে নিমগ্ন থাকতে দেখা যায়। ডিজিটাল ক্যামেরা, স্মার্টফোনে নিজের ছবি তুলে তা ফেসবুক, টুইটারে শেয়ার করে অন্যের মতামত পেতে আগ্রহী এই প্রজন্ম। গবেষকেরা এ প্রজন্মকে বলছেন ‘সেলফি’ প্রজন্ম। এ প্রজন্ম প্রযুক্তি ও নিজেকে নিয়ে ভাবতেই অভ্যস্ত। ভারচুয়াল জগতে বন্ধু তৈরি করে এই প্রজন্ম নিজেকে একাকী করে তুলছে বলেও ভারতের প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
ভারতের মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অঞ্জলি সাবরি বলেন, এখনকার প্রজন্মের তরুণরা ভারচুয়াল জগতে নিজেদের মনের মতো একটি জগত্ গড়ে তুলছে আর এই জগতে অধিকাংশ সময় সেলফি পোস্ট দিচ্ছে। সেলফি দিয়ে তার মনের ভুল ছবিটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে চাইছে তরুণরা।
ছবি-বিষয়ক পরামর্শক সিনা আগরওয়াল জানিয়েছেন, আমরা যে অস্তিত্বশীল এটা জানান দেওয়ার জন্যই অনেক আমরা ছবি শেয়ার করি এবং আমরা যাঁদের কোনোদিন দেখিনি তাঁদের কাছে প্রশংসা কুড়িয়ে মানসিক শান্তি পাই। এভাবে অন্যকে খুশি করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় কাছের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছি না। এ ছাড়াও সেলফি পোস্ট করার উদ্দেশ্য থাকে বেশি করে মন্তব্য ও লাইক পাওয়া। কিন্তু ছবি পোস্ট করার পর আশানুরূপ সাড়া না পেলে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন।
সেলফি পোস্ট করা দোষের কিছু?
বর্তমান প্রজন্ম যতই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুন না কেনো অনেকেই আবার মনে করেন সেলফি পোস্ট করা একেবারে খারাপ কিছু নয়। ছবি-বিষয়ক পরামর্শক সিনা আগরওয়াল বলেন, সেলফির মাধ্যমে নিজের প্রতি ভালোবাসা বোঝা যায়। এটি নিজেকে মানসিক শক্তির একটি উপায় হতে পারে। নিজের আত্মবিশ্বাসকে এবং নিজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্তকে স্মরণ করতে আমরা সেলফিতে ক্লিক করি।
সম্প্রতি নিজের ছবি তোলা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা একটি গবেষণা করেছিলেন। এ গবেষণায় দেখা যায়, সেলফি পোস্ট করার পেছনে মানুষের যতখানি না লোক দেখানোর বিষয় থাকে তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ ও নিজের সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকে। ছুটির দিন ও সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ড উপলক্ষে মানুষ বেশি নিজের ছবি তুলে রাখে। গবেষকেরা বলেন, নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পেতে সেলফি পোস্ট করেন। আমি কে বা আমি কী করি তা জানাতেই অনেকেই পোস্ট করেন নিজের ছবি।
সেলফির কিছু শিষ্টাচার
সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ছবি পোস্ট করার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কিছু শিষ্টাচার মেনে চলার পরামর্শ দেন।
১. নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার পর তাতে যে মন্তব্য বা লাইক আসে তা নিয়ে নিজের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা মোটেও ঠিক নয়। নিজের আত্মবিশ্বাস ও অতি-আত্মবিশ্বাসের মধ্যে অবশ্যই সীমারেখা থাকতে হবে।
২. ছবি পোস্ট করার সময় সচেতন হয়ে ছবি নির্বাচন করে পোস্ট করা উচিত। ছবি পোস্ট করার পর বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার আশায় দিনে একাধিকবার ছবি পোস্ট করার অভ্যাস না দাঁড়িয়ে যায়।
৩. সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই এসব সাইটে ছবি খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কাও থাকে। সামাজিক যোগাযোগের সাইটে প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখা প্রয়োজন।