ছুটে চলা বাইকে

মনের ভেতরের আমার লুকানো সাহস বেলছে, তুমি পারবে। অনেক দ্বিধা অনেক দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনে হলো আমিও পারব। এই প্রথম মায়ের অবাধ্য হলাম। শুরুতে মা চাইছিলেন না আমি বাইক চালাই।
সবার মতো নিরুৎসাহিত করল না আমার কর্মক্ষেত্র দৈনিক প্রথম আলো। আমার ইচ্ছাপূরণে এগিয়ে এল। এ বছর আগস্টের ২ তারিখে প্রথম আলো থেকে আমাকে একটা মোটর বাইক দেওয়া হয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার প্রেসক্লাবের ভেতরে আলোকচিত্রী দিপা ঘোষের বাইকে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলাম। দুরু দুরু সাহস নিয়ে শক্ত হাত দিয়ে অ্যাকসিলারেটর ধরলাম। বেশ কষ্টে আয়ত্তে আনলাম বাইক। প্রথম চালাতে পারলাম ৭ আগস্ট। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলাম। চিৎকার করে দুনিয়াকে জানাতে চাইলাম, আমি পেরেছি, সত্যিই পেরেছি। ঠান্ডা বাতাস চোখেমুখে এসে লাগল।
আমার মতো এই শহরে অনেকেই বাইক চালান। তেমন একজন দিপা ঘোষ। নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছোটেন। বাধার প্রশ্নে উত্তর দিলেন, ‘শত বাধা পেরিয়ে এই কাজ করি। এই কাজের আনন্দ অন্য কোনো কাজে নেই। স্বামী সহযোগিতা করেন। ছেলেমেয়েও সহায়তা করে। সারা দিন খাটুনির পর রাতে বাইক গ্যারেজে ওঠাতে পারি না, ছেলে উঠিয়ে দেয়।’

হাজারো উৎসাহী চোখ এড়িয়ে নিজের আত্মবিশ্বাসে ঢাকা শহরে অনেক নারীই নিজস্ব বাহন হিসেবে বাইক চালান।
এমন একজন জয়িতা রায়। তিনি প্রায় তিন বছর ধরে মোটরবাইক চালিয়ে সাংবাদিকতা করেন। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, প্রায়ই গাড়ি নিয়ে ঝামেলা হয়। মাঝপথে টায়ার নষ্ট, হাওয়া কমে যায়। অনেক দিন ঠেলে ঠেলে দোকানে নিয়ে যেতে হয়েছে। তারপরও ঢাকা শহরের গণপরিবহনে চলাফেরা করার হাত থেকে বাঁচা যায়।
রাস্তায় বের হলে মন্দ কথার অভাব হয় না। অতি উৎসাহ নিয়ে সাহায্য করতে চান অনেকে। মুখে হাসি টেনে নিজের অভিজ্ঞতা বললেন রেহেনা আক্তার। তিনি পাক্ষিক অনন্যার আলোকচিত্রী। রাস্তায় ছেলেরা যাচ্ছে, তাতে কেউ কাজ থামিয়ে দেখছে না, তবে মেয়েরা বাইক চালিয়ে গেলে অন্যভাবে তাকায়। তিনি আরও বলেন, সিএনজি অটো, বাস, লেগুনার চালকেরা নারীদের রাস্তায় দেখলে জোরে হর্ন দিয়ে চাপাতে থাকে। আর বাজে কথা তো আছে।
এমন হাজারো বাধা পেরিয়ে নারী এগিয়ে যাচ্ছেন। এমনটা দেখা গেল পুরান ঢাকার চকবাজারে। নাজমা আলীর নামের এক নারী শক্ত হাতে অ্যাকসিলারেটর ধরে আছেন। মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ বাইক গেল থেমে। মাঝপথে বাইক নিয়ে মহা বিপদে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে নারীদের মোটরবাইক সারাইয়ের দোকান খুব একটা নেই। কেউ কেউ ঝামেলা বলে, নিতে চায় না। পরিবারের সদস্যরা বলেন, “তোমাকে বাইক চালাতে হবে?”
স্করপিও কোম্পানির শাহানা পারভীন বলেন, ‘যত কিছুই হোক, বাইক চালাতে আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। দেড় বছর ধরে বাইক চালাই। রাস্তায় অন্য মেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে যখন হাসে, তখন খুব ভালো লাগে। মনে হয় কোনো ভুল করিনি। কোনো ছেলে যখন রেস দিতে চায়, তখন বিরক্ত হলেও কিছু মনে করি না।’ প্রথমে সন্ধ্যার পরে ভয় লাগত, এখন সাহস হয়ে গেছে। স্কুটির জন্য আলাদা লেনের দাবিও জানালেন তিনি।
ঢাকায় এখন প্রায় দেড় শ নারী মোটরসাইকেল চালক আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন কম্পিউটার প্রকৌশলী ইশরাত খান মজলিশ। তিনি শহুরে নারী বাইকারদের নিয়ে একটি সংগঠন করেছেন, নাম দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ ওমেন রাইডারস ক্লাব’। জানালেন, রাস্তায় বের হলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়, একটি গ্রুপ থাকলে তা মোকাবিলা করতে অনেক সুবিধা হয়। প্রায় বছর দেড়েক আগে আমরা এটা শুরু করি।
টিভিএসের হেড অব বিজনেস বিপ্লব কুমার রায় প্রথম আলোকে জানান, আগের থেকে এখন মেয়েদের বাইক কেনার প্রবণতা বেড়েছে। কিছু বেসরকারি সংস্থা এ বছর তাদের নারী কর্মীদের জন্য অনেকগুলো মোটরবাইক কিনেছে।