জগন্নাথে কেন পড়ি?

১৬ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬৩ বছরের ইতিহাস
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

১৬ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬৩ বছরের ইতিহাস। ১৮৫৮ সালে ‘ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল’ নামে যাত্রা শুরু করেছিল যে প্রতিষ্ঠান, নানা পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেটিই এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাস পুরান ঢাকায়। আয়তন সাত একর।

‘দেশে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ই সেরা,’ এমনটাও দাবি করলেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিলন হোসেন। ক্যাম্পাসে পড়ালেখার পাশাপাশি নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তিনি। বলছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেকে সেরা প্রমাণ করার একটা তাগিদ আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থী জানে, কঠোর পরিশ্রম ছাড়া সফল হওয়া যায় না। খেয়াল করলে দেখবেন, দেশের সব কটি প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা ভালো অবস্থান পায়। এখানে পড়ালেখার পাশাপাশি আমরা নানা রকম সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত থাকি বলে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলা সহজ হয়।’

শহরের ডাকে

ঢাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এ কারণেও ভর্তির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরপরই অনেকের দ্বিতীয় পছন্দের অবস্থানে থাকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সায়মা ইয়ান বলছিলেন, ‘ঢাকায় পড়াশোনা করার ইচ্ছা থেকেই মূলত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেছি। পুরান ঢাকার নিজস্বতা, এখানকার মানুষের আতিথেয়তা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানী শহরকেন্দ্রিক পড়াশোনার জন্যই এখানে আসা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে ক্যাম্পাসে যাওয়া–আসার আনন্দ আলাদা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শহরের আনাচকানাচ থেকেও জগন্নাথে পড়তে আসেন শিক্ষার্থীরা। ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফজলুল হককে যেমন নিয়মিত উত্তরা থেকে সদরঘাট যেতে হয় ক্লাস ধরার জন্য। ঢাকার যানজট ঠেলে এই যাত্রা নাকি তিনি উপভোগই করেন। ফজলুল হক বলছিলেন, ‘প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করার একটা আলাদা মজা আছে। সকালে যখন লাল বাসে করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, সবাই আলাদা চোখে দেখে। আর বিকেলে বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে, সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরার আনন্দ বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বড় প্রাপ্তি।’

ফজলুলদের অবশ্য এই আনন্দ উপভোগ করা হয়নি প্রায় দুই বছর। করোনায় বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস। তবে সে সময় সেশনজট এড়াতে শুরু থেকেই অনলাইনে ক্লাস চালু রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার মধ্যেই ছিলেন। ক্যাম্পাস খোলার পরপরই সশরীর পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ক্লাসে ফিরতে পেরে শিক্ষার্থীরা যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। আবার নানা উৎসব, আয়োজনে মুখর হয়েছে চেনা প্রাঙ্গণ।

আড্ডায় মুখর প্রাঙ্গণ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

মানসিক স্বাস্থ্যে নজর

করোনার বন্ধের পর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আধুনিক মেডিকেল সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। দুজন চিকিৎসক, দুজন টেকনিক্যাল অফিসার, একজন মেডিকেল সহকারীসহ আরও কয়েকজন মিলে সেবা দিচ্ছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য মেডিকেল সেন্টারে সাতটি শয্যা আছে। মেডিকেল সেন্টার থেকে দেওয়া হয় প্রায় ৩৫ ধরনের ওষুধ। প্রতিদিন শতাধিক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস চলাকালে মেডিকেল সেন্টার থেকে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন।

মেডিকেল সেন্টারের উপপ্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা মিতা শবনম বলেন, ‘ক্লাস বা পরীক্ষার সময় যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা না হয়, সেটি আমরা দেখভাল করি। প্রয়োজনে তাঁদের হাসপাতালে রেফার করার ব্যবস্থা নিই। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও সেবা নেন।’

দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জগন্নাথের ছাত্রছাত্রীদের এ সমস্যা থেকে বের করে আনতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২৮ জন শিক্ষার্থী কাউন্সেলিং সেন্টার থেকে সেবা নিয়েছেন।

কাউন্সেলিং সেন্টারের পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ বলেন, যেকোনো শিক্ষার্থী কাউন্সেলিংয়ের জন্য সময় নিতে পারেন। যেসব শিক্ষার্থীর তুলনামূলক একই সমস্যা দেখা যায়, তাঁদের গ্রুপ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। সেন্টারে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সুবিধা পাবেন।

খেলাধুলায়ও পিছিয়ে নেই

ক্যাম্পাস থেকে কিছুটা দূরের ধূপখোলা মাঠটি এত দিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। সিটি করপোরেশন সেখানে মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু করায় শিক্ষার্থীদের জন্য মাঠ ব্যবহারের সুযোগ আর থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস কেরানীগঞ্জে একটি খেলার মাঠ তৈরি করা হচ্ছে। সেখানেই হবে খেলাধুলার আয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষা কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক গৌতম কুমার বলেন, ‘ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ক্যারম, দাবা, জুডোসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমাদের রয়েছে বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ, বিভিন্ন পর্যায়ের ক্লাব ও ফেডারেশনের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মারজান আক্তার ২০১৯ সালে সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে একক কুমি ইভেন্টে সোনা জিতেছেন। দলগত কুমিতেও পেয়েছেন ব্রোঞ্জপদক। জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় শহিদুল ইসলামও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী।

নতুন ক্যাম্পাসের অপেক্ষা

ঢাকার অদূরে, কেরানীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ২০০ একর জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। সেখানে তৈরি হবে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ক্যাম্পাস। নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সব সদস্য আবাসিক, একাডেমিকসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন বলে মনে করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক সাহাদাত হোসেন বলেন, প্রথম ধাপের অংশ হিসেবে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ ৩৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান পাওয়া গেলে ভূমি উন্নয়নের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক জানালেন, নতুন ক্যাম্পাসের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে ১৫ জুন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাঁরা আগামী চার মাসের মধ্যে নতুন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা সাজাবেন।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড

বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিবুদ্ধি চর্চার স্থান। আর এই চর্চার বড় প্ল্যাটফর্ম হলো ক্যাম্পাসের সংগঠনগুলো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আবৃত্তি সংসদ, উদীচী, ফিল্ম সোসাইটি, ফটোগ্রাফি সোসাইটি—এ ধরনের সংগঠনগুলো সারা বছরই মাতিয়ে রাখে ক্যাম্পাস।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সার্বিক সহযোগিতা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সব রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাঙালির উৎসবগুলো আমরা উদ্‌যাপন করি। এর মধ্যে নবীন আগমনী উৎসব, নতুনের গান, একুশের আহ্বান, স্বাধীনতার বাংলাদেশ, শীতকালীন উৎসব, বসন্তবরণ, চৈত্রের গান, পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন, বর্ষাবরণ, শোকের চিত্রায়ণ, নৃত্যের ঝুমুর, বাউল উৎসব, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে থাকে স্বকীয় অংশগ্রহণ।’

নিজস্ব একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান করতে চাই

ইমদাদুল হক, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

ইমদাদুল হক, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা। এ জন্য গবেষণার মানোন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পাসে যেহেতু গবেষণার সুবিধা পর্যাপ্ত নয়, তাই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা তাঁদের প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ পাবেন। গবেষকদের সুবিধার্থে বছরে দুবার এমফিল ও পিএইচডিতে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ গবেষকদের জন্য ফেলোশিপ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে চাই। শিক্ষার্থীরা যেন পড়ালেখায় আরও মনোযোগী হয়, সে জন্য ডিনস অ্যাওয়ার্ড চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের মেধাবৃত্তি ও অবৈতনিক বৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়েছি।

করোনার ধাক্কার পর শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক যত্নের বিষয়টিতে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও একমাত্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের করোনা টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে ক্যাম্পাসে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার ব্যবস্থাও আমরা করেছি।

একনজরে

প্রতিষ্ঠা: ২০০৫ সাল

আয়তন: ৭ একর

মোট শিক্ষার্থী: ১৪ হাজার ২৭০ জন

মোট শিক্ষক: ৬৭৮ জন

বিভাগ: ৩৬টি

ইনস্টিটিউট: ২টি

ক্যাম্পাসের বাস: ৫৫টি