জনগণের পাশে ছিলাম, থাকব

সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে। কর্মীরাও মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর মাঠে নামতে প্রস্তুত। সবার হাতে লিফলেট, পোস্টার। আজকের যাত্রা মগবাজার পেয়ারাবাগ কলোনি। তবে এলাকার জনগণ কলোনিটাকে ১২ নম্বর বস্তি বলতেই অভ্যস্ত। মোটামুটি বড়সড় একটা মানুষের মিছিল এগিয়ে চলেছে। সামনে ধীরগতিতে এগোচ্ছে মাইকিংয়ের রিকশা। ‘মিষ্টিকুমড়ায় দিলে ভোট, শান্তি পাবে এলাকার লোক’, ‘শরমিলা আপার দুই নয়ন, এই ওয়ার্ডের উন্নয়ন’—এ রকম স্লোগানে উচ্চকিত চারদিক। শরমিলা ইমাম হাত নাড়তে নাড়তে, প্রচারপত্র বিলোতে বিলোতে এগিয়ে চলছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৫ নম্বর সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী শরমিলা ইমাম। তাঁর মার্কা মিষ্টিকুমড়া। তিনি কেমন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন, সেটা দেখতেই ২৩ এপ্রিল বিকেলে মগবাজার গিয়ে হাজির হই।
বাজারের পথ ধরে মিছিলটা চলছিল। কিছু মানুষ তাঁকে দেখে এগিয়ে এলেন। এর মধ্যে মুরগির দোকানদার, পান বিক্রেতা, সবজির দোকানি—কেউই বাদ নেই। একজন বৃদ্ধ শরমিলা ইমামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘কেমন আছেন আপনে? আমার কাছে ভোট চাইতে হইব না। ভাইরেও ভোট দিছি। আপনেরেও দিমু।’ জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার স্বামীও তো রাজনীতি করতেন?’
‘হ্যাঁ। আমার স্বামী খালেদ ইমাম। সে এই ওয়ার্ডের (সাবেক ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড) চেয়ারম্যান ও কমিশনার ছিল। সে জনগণের জন্য অনেক কাজ করেছে। এ জন্য এলাকাবাসী এখনো তাকে মনে রেখেছে। ২০০১ সালে কয়েকজন দুষ্কৃতকারী তাকে হত্যা করে।’
‘আপনি কি তার পর থেকেই রাজনীতি করছেন?
‘আমার স্বামী ও আমি একই সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করি। তারপর বিয়ে। বিয়ের পরপরই ও রাজনীতিতে যুক্ত হয়। তখন থেকেই ওর কাজে সহযোগিতা করেছি। সব সময় উৎসাহ জুগিয়েছি। কিন্তু তার মৃত্যুর পরই সব পাল্টে গেল। দুর্বৃত্তরা তাকে খুন করল। তখন মনে হয়েছিল স্বামীর অসমাপ্ত কাজ আমাকেই করতে হবে। জনগণও আমাকে চাইছিল। ২০০২ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জনগণের ভোটে কমিশনার নির্বাচিত হই। এরপর দীর্ঘ ১৩ বছর জনগণের জন্যই কাজ করে যাচ্ছি।’
একপর্যায়ে শরমিলা ইমামসহ মিছিলটা পেয়ারাবাগ কলোনির সামনে হাজির। সঙ্গে সঙ্গেই কলোনির ভেতর থেকে আরও একটা ছোট্ট মিছিল জুড়ে গেল বড় মিছিলটার সঙ্গে।
কলোনির প্রতি ঘরে ঘরে প্রচারণা চালাচ্ছেন শরমিলা ইমাম। এরই মধ্যে একজনকে তিনি বললেন, ‘ভুইলেন না আমারে, বিদায় দিয়েন না আমারে।’
অথবা আরও একজনকে বললেন, ‘তুই আমার আদরের ভাই, ভোটটা দিস আমারে!’
এরই মধ্যে একজন এগিয়ে এলেন। ‘ভাবি, চিনছেন আমারে? যখন খালেদ ভাইয়ের মাটির ঘর আছিল, তহন থেইক্যা বন্ধু আমরা।’
শরমিলা ইমামের পাশ থেকে তাঁর বোন লাভলী খুরশিদ বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ ভাই, আপনি তো ভাইয়ের পাশে ছিলেন। আপার পাশেও থাকবেন।’
লাভলী খুরশিদ ধানমন্ডি থানায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বললেন, ‘দুই বোনের রাজনীতি আলাদা। সেইটা মাঠে। কিন্তু এখন তো বোন নির্বাচন করছে। তার পাশে তো আমার থাকা দরকার। বোন তো বোনের কাজে আসতেই পারে! ’
হাতিরঝিলে চা বিক্রি করেন পারভীন আক্তার। তিনিও এসেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ে আমার বানানো পান খাইত। ভাবির দুঃখের দিন তার পাশে আছিলাম। এহনও আছি।’
কলোনি থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা নেমে গেছে। তবু ক্লান্তি নেই যেন। আর মাত্র কয়েকটা দিন। এরই মধ্যে আরও অনেক এলাকায় যেতে হবে প্রচারণায়। এবারের গন্তব্য গ্রিনওয়ে এলাকা।
এই এলাকার প্রতিটা বাড়ির দরজায় ঘুরে ভোট চাইছেন। ভবিষ্যতে নির্বাচিত হলে এলাকার জনগণের জন্য কী কাজ করবেন, লোকজনকে বোঝাচ্ছেন। দোয়া চাইছেন। প্রচারণা শেষ হতে হতে রাত ১০টা। আজকের মতো বিরতি। বিদায়ের আগে আবারও প্রশ্ন করি। ‘কী মনে হচ্ছে, আপনি জিতবেন?’
পাল্টা প্রশ্ন আমাকেই, ‘কেমন দেখছেন? দেখছেন তো এলাকার জনগণ আমাকে কত ভালোবাসে? আমার স্বামীকে কত ভালোবাসে? অসহযোগিতা আছে অনেক। অনেকেই হুমকি দিচ্ছে। নির্বাচন থেকে সরে যেতে বলছে। এই ওয়ার্ডে ১৩ জন কমিশনার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আমিই একমাত্র নারী প্রার্থী। কিন্তু তাতে আমার কোনো ভয় নেই। কারণ, আমি জনগণের জন্য কাজ করেছি। জনগণ আমার সঙ্গে আছে। জনগণের জন্যই আমি কাজ করতে চাই।’
‘আপনি নির্বাচিত হলে এলাকার উন্নয়নে কী কী করবেন?
‘প্রথমেই পেয়ারবাগ কলোনির জনগণ যাতে গ্যাসের সুবিধা পায়, সে ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া এই ওয়ার্ডের সন্ত্রাস ও দুর্নীতি নির্মূল করতে কাজ করব। আগে যেমন জনগণের পাশে ছিলাম, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকব।’