জাতীয় জীবনে মুরব্বিদের ভূমিকা

আঁকা: রাজীব
আঁকা: রাজীব

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো আমার দাদাও সব সময়ই অস্থির থাকেন। দাদার ধারণা, পৃথিবীর সব সমস্যা নিয়ে তাঁকেই চিন্তা করতে হবে। তিনিসহ ছয়জন মানুষ বাসায়। প্রত্যেকের চিন্তার সুষম বণ্টন হওয়া উচিত। কিন্তু সবার চিন্তা নিজের মাথায় নিয়ে রেখেছেন দাদা। পত্রিকা দিতে কেন দেরি হলো থেকে শুরু করে গভীর রাতে কুকুর কেন ডাকছে—সব নিয়েই তাঁর চিন্তা। অনেক সময় নিজের ‘বর্ণাঢ্য’ জীবনের অসংখ্য অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে সমস্যা সমাধানে হাজির হন তিনি। মুরব্বি মানুষ, কেউ ঘাঁটায় না তাঁকে। আমিও সব সময় চেষ্টা করি তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকার। কিন্তু খুব বেশি দূরে যাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। যেহেতু আমরা একই বাসায় থাকি এবং আমি সবার ছোট, ফলে দাদার সামনে আমাকে পড়তেই হয়।
দাদা আমাদের বাসায় এসে অবস্থান নিয়েছেন অনেক দিন হয়ে গেল। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ‘গ্রামে ফিরে যাও’ রচনাটা তিনি কখনোই পড়েননি। পড়লে নিশ্চয়ই ব্যাগ গুছিয়ে গ্রামে ফিরে যেতেন। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি, দাদা-দাদি এলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় নাতি-নাতনিরা। সন্ধ্যায় তারা দাদার কাছে গল্প শোনে। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন পদার্থ। আমার দাদা ঠিক গল্প-উপন্যাসের দাদার মতো নন। আর সব দাদা-নানার মতো তিনিও একজন সাধারণ বৃদ্ধ (ছোটবেলা থেকেই দেখছি, পৃথিবীর সব দাদা-নানাই বৃদ্ধ। কী অদ্ভুত!), যাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য সবাইকে উপদেশ দেওয়া আর টিভির রিমোট দখল করে টক-শো দেখা এবং হঠাৎ হঠাৎ ‘দেশটা শেষ করে ফেলল জালিমের দল’ বলে চিত্কার করা। তবে রাতে যখন আমরা খেতে বসি, তখন আমার দাদাও গল্প বলেন। অধিকাংশই ফুলকপি, পালংশাক, কাতলা মাছ কিংবা জাম্বুরার গল্প। ‘আহ্হারে! টমেটো-শসাও এখন কিনে খেতে হয়। এসব তো আমাদের খেতে পড়েই থাকত। জাম্বুরা দিয়ে কত ফুটবল খেলেছি...আর এখন কেমিক্যাল-টেমিক্যাল দিয়ে একেবারে সব শেষ করে ফেলল। জালিমের দল সব।’
রোজ সকাল ছয়টায় বাড়ির সবাইকে ঘুম থেকে জাগান দাদা। তখন তাঁর হাঁটতে যাওয়ার সময়। আমাকে ডেকে বলেন, ‘কিরে, ঘুমাচ্ছিস? এই বয়সে এতক্ষণ ঘুমায় কেউ? দেশের উন্নতি হবে কী করে? উঠে পড়তে বস। আমি হাঁটতে গেলাম।’
এ জন্যই মুরব্বিদের ভালো লাগে না আমার। দেখামাত্র উপদেশ দিতে থাকেন তাঁরা। অথচ দাদার কারণেই ঘুমাতে দেরি হয় আমার। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন বিকট শব্দে নাক ডাকা শুরু করেন দাদা। মাঝেমধ্যে নাক ডাকার মাঝে বিজ্ঞাপন বিরতি হিসেবে থাকে খুকখুক কাশি। ঘুম কি আর আসে! মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলি, ‘দাদা, তুমি যে বাড়িঘর ফেলে এই ধুলো, জ্যাম, গাড়ির হর্নের শহরে থাকছ, তোমার খারাপ লাগে না? ইচ্ছে করে না অলস দুপুরে পুকুরঘাটে বসে টলটলে পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে?’
দাদা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলেন, ‘নাহ্।’
‘কেন?’
‘পুকুরে তো পানিই নাই। তাকিয়ে কী দেখব?’
একেবারে দাঁতভাঙা জবাব। দাদার বেশ কয়েকটা দাঁত ভাঙা, ফলে উনি দাঁতভাঙা জবাব দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কত দিন আর এসব জবাব ভালো লাগে? তার ওপর হাঁটতে গিয়ে দাদার কিছু বন্ধুবান্ধবও জুটেছে। প্রায়ই তাঁরা সদলবলে এসে দেশ ও বিশ্বের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে চারকোনা টেবিল বৈঠক করেন। সে সময় টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ থাকলেও মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনতে শুনতে খবর দেখতে হয় আমাকে।
এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন দাদা ঘোষণা দিলেন, তাঁকে একটা লাঠি কিনে দিতে হবে। তিনি সকালে লাঠি নিয়ে হাঁটতে যাবেন। আমরা তো অবাক। সুস্থ সবল মানুষ, হেঁটে তিনতলা উঠছেন, নামছেন। তাঁর জন্য লাঠি লাগবে কেন? বাবা বললেন, ‘লাঠি কেন? তোমার কি পায়ে সমস্যা?’
‘সমস্যা ছাড়া লাঠি ব্যবহার করা যাবে না, এটা কোথাও লেখা আছে? লাঠি কি পিস্তল যে কিনতে লাইসেন্স লাগবে?’
‘রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘গাধার মতো কথা বলছিস, তাই।’
‘যাদের হাঁটতে কষ্ট হয়, তারাই না লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটে। তোমার তো কোনো সমস্যা নাই। শুধু শুধু লাঠি কিনবে কেন?’
‘এ বয়সে একটা জিনিস চাইছি, তা-ও এত প্রশ্ন! ছোটবেলায় তুই কিছু চাইলে আমি কি দেই নাই? কত দাম একটা লাঠির? তোর টাকা না থাকলে বল। আমি বাড়ির ডাব বিক্রি করে...’
‘থাক থাক। আমি লাঠি কিনে আনছি।’

বিকেলেই ৮০০ টাকা দিয়ে একটা লাঠি কিনে আনলেন বাবা। সে কী লাঠি! হাতলে নরম গ্রিপ। চাইলে ছোট-বড় করা যায় লাঠিটা। আবার দিকনির্দেশনার জন্য কম্পাসও আছে। মোবাইল ফোনের সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে সেলফি স্টিক হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যেত। আধুনিক লাঠি পেয়ে দাদা তো খুব খুশি। নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, লাঠিটা দিয়ে তুমি কী করবে?’
‘কুত্তা পেটাব।’
‘মানে?’
‘হ্যাঁ। সকালে হাঁটার সময় কুত্তা খুব ডিস্টার্ব করে। যতবার হাঁটতে যাই, পায়ের কাছে ঘেউ ঘেউ করে। যত বড় মুখ নয়, তত বড় ঘেউ! এবার আসুক, দেখিয়ে দেব।’
দাদা এমনই। অর্থহীন কাজের জন্য অর্থ খরচ করেন। কুকুর তাড়াতে ৮০০ টাকার লাঠি! শুনে মা মুচকি হাসলেও অনেকক্ষণ কোনো কথা বললেন না বাবা। আমিও জলজ্যান্ত একটা ইস্যু পেয়ে রাতে স্ট্যাটাস দিলাম ফেসবুকে, ‘জাতীয় জীবনে দাদার মতো মুরব্বিদের ভূমিকাটা কী? “অমুকের বিয়ের অনুষ্ঠানে হাত ধুতে যাওয়ার সময় তোমার সঙ্গে দেখা, কই সালাম তো দিলে না!”-টাইপ বক্তৃতাই দেবেন তাঁরা। আর দেবেন উপদেশ। এ ছাড়া মুরব্বিদের আর কিছু দেওয়ার আছে বলে মনে হয় না। যা করার আমাদের মতো তরুণ উদীয়মানদেরই করতে হবে।’ লাইক-কমেন্টের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে একসময় তলিয়ে গেলাম ঘুমে।
ভোরে ঘুম থেকে ডেকে ওঠালেন দাদা। তাঁর সঙ্গে হাঁটতে যেতে হবে। শীতের সকালে লেপের তলা ছেড়ে কারও বেরোতে ইচ্ছে করে? তবুও যেতে হলো। গিয়ে দেখি, কম্বলের এক বিশাল বান্ডিল অপেক্ষা করছে আমার জন্য। দাদার আদেশ, ‘এগুলো নিয়ে চল আমার সঙ্গে।’
কম্বলের বোঝা নিয়ে দাদার পেছনে পেছনে যাচ্ছি আমি। চোখে ঘুম, মনে বিরক্তি। পার্কের কাছে এসে দেখি, দাদার যে বৃদ্ধ বন্ধুরা আমাদের বাসায় বসে রাজীনিতির আলোচনা করেন, জড়ো হয়েছেন তাঁরাও। তাঁদের সামনেও কম্বলের বান্ডিল। পেছনে একটা পিকআপও দেখছি। বুঝতে বাকি রইল না যে প্রবীণ সংঘ নামে একটা সংগঠন করেছেন তাঁরা। সেখান থেকে শীতার্তদের দেওয়া হবে কম্বলগুলো। কম্বলের বান্ডিলটা নামিয়ে রাখতেই দাদা বললেন, ‘তোর কাজ শেষ। তুই চলে যা। এগুলো ঠিকঠাকভাবে দিয়ে বাসায় আসব আমি। তোর মাকে বলিস।’
আমার একটু লজ্জাই লাগল। এই কাজটা তো আমার, আমাদের করার কথা ছিল। ফেসবুকে ‘কিছু করতে হবে’-টাইপ স্ট্যাটাসই দিয়ে গেলাম আমরা, করে ফেললেন দাদার মতো বৃদ্ধরা! হঠাৎ মনে হলো, দাদা নয়, আমিই বৃদ্ধ। কাছে গিয়ে দাদাকে বললাম, ‘আমিও যাব।’
‘যাবি? সব বুড়োর মাঝে তুই বোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়বি তো।’
‘তোমার জ্বালায় কেউ ঘুমাতে পারে নাকি?’
‘চল তাহলে।’
কাঁধে হাত দিয়ে এগোতে শুরু করলেন দাদা। এই প্রথম তাঁকে বন্ধুর মতো আপন মনে হলো আমার।