যাত্রী না পেয়ে এমনিতেই মনটা ভার ছিল তাঁর। তার ওপর আচমকা মেয়েজামাইয়ের ফোন কলটা মানসিক চাপে ফেলেছে আনারুল ইসলামকে। তাই রিকশায় উঠতে চেয়ে তাঁকে যখন ডাকলাম, একবাক্যেই বলে দিলেন, ‘ভাড়া মারবো না, মামা।’
বেলা তিনটার দিকে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন আনারুল ইসলাম (৪২)। আজ শনিবার রাত সাড়ে আটটা, প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা তিনি যাত্রীর আশায় ঘুরেছেন মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কলাবাগান এলাকায়।
আমার সঙ্গে দেখা হলো লালমাটিয়ার বি-ব্লকে। তখন পর্যন্ত কোনো যাত্রীর দেখা পাননি। তাই বাসায় ফিরছিলেন। ফিরছিলেন ক্লান্তি নিয়ে। এই ক্লান্তি শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। আনারুল ইসলাম যেমনটি বলছিলেন, ‘মামা, আজকে ১০৫ ট্যাকা লসে আছি, বুঝলেন’।
‘লোকসানের’ হিসাব বুঝিয়ে বলেন আনারুল ইসলাম নিজেই, ‘নিজের পরিশ্রম বাদই দিলাম। গ্যারেজে (রিকশামালিককে ভাড়া বাবদ) দিতে হইব ১০০ ট্যাকা। এর মধ্যে আবার ৫ ট্যাকা দিয়ে মাস্ক কিনছি। আয় তো এক ট্যাকাও হয় নাই।’
১০৫ টাকা লোকসানের কারণে যতটা না ভেঙে পড়েছেন আনারুল ইসলাম, তার চেয়ে ভেঙে পড়েছেন জামাইয়ের সেই ফোন কলটায়। মেয়েজামাই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। এই লকডাউনে কাজ বন্ধ। তাই আয়মূলক কিছু করবেন বলে শ্বশুর আনারুল ইসলামের কাছে ৫ হাজার টাকা চেয়েছেন। তখন সেই টাকা জোগাড়ের দুশ্চিন্তা নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকায় ফিরছিলেন আনারুল।
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলায় আনারুলের বাড়ি। ঢাকায় এসে কয়েক বছর রাজারবাগে একটি সরকারি সংস্থার বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। বেতন না বাড়ায় ২০০১ সাল থেকে রিকশা চালানো শুরু করেন। বর্তমানে ১২ বছরের ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে শেখেরটেক এলাকার এক ভাড়া বাসায় থাকেন। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন নিজের এলাকায়। জামাইদের যৌতুক দিতে হয়েছে। সেই যৌতুক পুরোপুরি শোধ করতে পারেননি আনারুল। মাসে মাসে টাকা জমিয়ে শোধ করছেন। এর মধ্যে এসেছে করোনা, লকডাউন।
আনারুল ইসলাম বলছিলেন, ‘বাড়িওয়ালি (আনারুলের স্ত্রী) এক সাহেবের বাসায় কাজ করত, চাকরিটা আর নাই। আমারও যদি এইরম (আয়) হয়, যামু কই, মামা।’
রিকশাচালক আনারুল ইসলাম যেন নিজেই সেই উত্তর খুঁজে নেন। কথা থামিয়ে থুতনি থেকে সার্জিক্যাল মাস্কটা মুখে তুলে নেন। দুই পায়ে রিকশায় প্যাডেল মারেন গন্তব্যের দিকে। এই গন্তব্যটুকুই তাঁর চেনা।