জিরো ফিগার করতে গিয়ে...

কোমর চিকন করতে গিয়ে যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ি। ছবি: অধুনা
কোমর চিকন করতে গিয়ে যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ি। ছবি: অধুনা

ব্রাজিলের মডেল আনা ক্যারোলিনা রেস্টনকে মনে আছে? কিডনি অকেজো হয়ে প্রায় ২০ দিন হাসপাতালে থেকে মারা যান। বয়স ছিল তখন মাত্র ২১ বছর। উচ্চতা যদিও ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি ছিল, তবে ওজন মাত্র ৪০ কেজি। তারপরও এই ওজন তাঁর কাছে বেশি মনে হচ্ছিল। ধারণা করছিলেন এ কারণে তিনি অনাকর্ষণীয় হয়ে যাচ্ছেন। এটা একধরনের রোগ। যার নাম অ্যানোরেক্সিয়া। শুকনো হলেই সুন্দর, এমন ভুল ধারণা থেকে দেখা যায় অনেক মেয়ে অ্যানোরেক্সিয়ায় ভোগেন। না খেয়ে থাকতে থাকতে যখন ক্রনিক আকার ধারণ করে তখন তাকে অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা বলে।

এই রোগ ভয়ংকরভাবে মেয়েদের আসক্ত করেছে, বিশেষত বয়ঃসন্ধির মেয়েদের। এবার তা থেকে বাঁচতে বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো করছে নতুন কিছু। ফ্যাশনের জন্য যাদের সুনাম পৃথিবীজুড়ে, যেমন ডিওর, গুচি, লুই ভুইটন—তারা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে এখন থেকে আর অত শুকনো মানে জিরো সাইজ মডেল নয়!
স্কুল-কলেজ, অফিস বা পরিবারেই স্থূলকায় মেয়েটিকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে সবাই। একসময় তার ধারণাই হয়ে যায় যেহেতু সে স্থূলকায়, তাই সে কারও কাছেই আকর্ষণীয় না। শুরু হয় ওজন কমানোর দৌড়। না খেয়ে থাকা, নানা অজুহাতে খাবার না খাওয়া বা খেলেও বমি করে ফেলা—নানাভাবে না খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে ওজন কমালেই সুন্দর লাগবে, এ ভ্রান্ত ধারণায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েরা। যেহেতু তারা নিজেদের নানা ধরনের শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে তখনো মানিয়ে উঠতে পারেনি, তাই আশপাশের কথা তাদের ওপর প্রভাব ফেলে।
অ্যানোরেক্সিয়াতে আক্রান্ত মেয়েদের ওজন তাদের স্বাভাবিক ওজন থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কম হতে পারে। যার জন্য তৈরি হতে পারে আরও কিছু সমস্যা যেমন ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিষণ্নতা, মাথা ঘোরানো, লম্বা না হওয়া ইত্যাদি।

নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য যখন সবাই ব্যস্ত তখন বাড়তি ওজন কারওই ভালো লাগে না। তবে ওজন বেশি হয়ে যাওয়া যেমন প্রায় সব ধরনের অসুখের একটি অন্যতম কারণ, তেমন ওজন কমে যাওয়া বা অনেক বেশি কমে যাওয়াও কিন্তু খারাপ। খুব বেশি ওজন কমিয়ে ফেলার ব্যাপারে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, অনেকে দেখা যায় না বুঝেই ভাবে আমাকে যেকোনোভাবে ওজন কমাতেই হবে! সেখান থেকে শুরু করে না খেয়ে থাকার ডায়েট। এভাবে না খেয়ে থাকার জন্য তাদের অনেক ধরনের হরমোনাল গ্রোথ বাধাগ্রস্ত হয়। যা থেকে নানা ধরনের সাময়িক অসুখের বাইরেও একসময় বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
কিছুদিন আগেও সুন্দর মানেই হাড় জিরজিরে বা জিরো ফিগার বোঝাত। একটা সময় দেখা গেছে প্রচুর মডেল, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আগ্রহী মেয়ে এবং বয়ঃসন্ধির মেয়েরা ওজন কমাতে অ্যানোরেক্সিয়ায় ভুগতে শুরু করল। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে যেসব মানুষ অ্যানোরেক্সিয়াতে ভুগেছে তাদের ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে এটি ছিল সম্পূর্ণভাবে মানসিক অসুস্থতা। পুষ্টি কর্মকর্তা শামসুন্নাহার নাহিদ বলেন, ‘অ্যানোরেক্সিয়াতে ভোগা মেয়েদের সংখ্যা খুব কম না, তবে আশার কথা হচ্ছে ৫০ শতাংশ মানুষই কিন্তু সুস্থ হতে পারে। একটা মানুষকে প্রতিনিয়ত যদি তুমি মোটা তাই তুমি অসুন্দর বলতে শুরু করো তাহলে সে কিন্তু একসময় অ্যানোরেক্সিয়াতে আক্রান্ত হতে পারে। কেউ কেউ দেখা যায় মজা করে বলে, তুমি মোটা তাই তোমার বিয়ে হবে না, ছেলে পাওয়া যাবে না, এসব কথা কিন্তু খুব ক্ষতিকর। এরা খুব দ্রুত ওজন কমাতে খাবার না খেয়ে থাকে বা খাবার খেয়ে বমি করে ফেলে। কিন্তু দেখা যায় ঠিকমতো খাবার না খেলে ব্রেইনে গ্লুকোজ পৌঁছায় না, যার জন্য আমাদের শরীরের ফাংশনই বদলে যায়। অ্যানোরেক্সিয়া থেকে কিডনি অকেজো হতে পারে, হৃদ্‌যন্ত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
সৌন্দর্য একেবারেই আপেক্ষিক ব্যাপার। না খেয়ে ওজন কমিয়ে সুন্দর হওয়া যাবে না। তাই ওজনটা নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ থাকাটাই জরুরি। আর যদি আপনি অ্যানোরেক্সিয়াতে আক্রান্ত হয়েই থাকেন, তবে খুব বড় কোনো বিপদ হওয়ার আগেই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি প্রাণই আকর্ষণীয়। প্রতিটি মানুষই সুন্দর। তাই কোনো কিছুই বেশি বেশি ভালো নয়। বেশি ওজন যেমন ভালো নয়, আবার বেশি শুকাতে গিয়েও বিপদ।